সীমান্ত দাস : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য বীরত্ব ও অদম্য সাহসিকতার জন্য তাঁকে দুইবার ‘বীর প্রতীক’ পদকে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ কোন যোদ্ধাকে সরকার একই বীরত্ব দুইবার প্রদান করে সম্মানীত করলে নামের শেষে বীরত্ব উপাধি লেখার পর প্রথম বন্ধনীতে ‘বার’ (ইঅজ) লেখা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীকের খেতাবে ভূষিত হয়েছেন তাদের মধ্যে জহুরুল হক মুন্সীই একমাত্র দুইবার বীর প্রতীকের খেতাব অর্জন করেছেন। এজন্য তাকে বীর প্রতীক (বার) বলা হয়।
জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রাবাজ গ্রামের কৃষক গফুর মিয়ার ছেলে জহুরুল হক মুন্সী। বর্তমানে তিনি আমার জেলা শেরপুর-এর শ্রীবরদী পৌর শহরের খামারীয়া পাড়া মহল্লার বাসিন্দা। একাত্তরের ২৬ বছরের সেই টগবগে যুবক আজ বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুয়ে পড়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জের জাহাজ নির্মান সংস্থায় (ই.পি.আই.ডি.সি) মাসিক ৪৫ টাকা বেতনে চাকরি করতেন তিনি। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাদের হত্যাকান্ডের খবর নারায়ণগঞ্জে পৌঁছতেই স্বেচ্ছাসৈনিকরা নারায়নগঞ্জের চাষাড়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করেন। এদের মধ্যে জহুরুল হক মুন্সী একজন। পরে তিনি অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ফিরে আসেন নিজ জন্মস্থান বকশিগঞ্জে।
১৯৭১-এর ১২ এপ্রিল বকশিগঞ্জ লাগোয়া সীমান্তের ওপারে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নাম লেখান নাছির কোম্পানীতে। বিএসএফ এর ক্যাপ্টেন নিয়োগী’র তত্ত্বাবধানে শুরু হয় মৌলিক প্রশিক্ষণসহ বিশেষ প্রশিক্ষণ। মহেন্দ্রগঞ্জে দুই দফা প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে সাংগঠনিক কমান্ডার এবং পরবর্তীতে ইনটেলিজেন্স কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে নিযুক্ত হন। মেঘালয়ের তুরা ও চেরাপুঞ্জিতেও বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১-এ নারায়নগঞ্জ, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও বকশিগঞ্জ রণাঙ্গনে পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন তিনি।
১৯৭১-এর ৯ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের (ইৎরমধফরবৎ ঐধৎফবা ঝরহময কষবৎ) প্রথম মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রির (এমএলআই) তিনটি ব্যাটালিয়ান এবং আর্টিলারি রেজিমেন্ট নিয়ে জামালপুর পৌঁছে যান। এদিকে জামালপুরে পিটিআই চত্বরে পাকিস্তানি গ্যারিসনে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ প্রায় ১৫০০ সৈন্য, এক ব্যাটারি (৬টি) ভারি মর্টার, ৬ পাউন্ডার গান নিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। এ অবস্থান উচ্ছেদ না করে ভারতীয়দের দক্ষিণে অর্থাৎ টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রাভিযান ছিল অসম্ভব অথবা করলেও হতো অর্থহীন। অপরদিকে এ শক্ত অবস্থানের ওপর আক্রমণের অর্থ প্রচুর লোকবলের ক্ষতি। এ অবস্থায় বিগ্রেডিয়ার ক্লের আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখলেন লে. কর্নেল সুলতানের কাছে।
কিন্তু সমস্য দেখা দিল কে নিয়ে যাবে এ চিঠি পাকিস্তানীদের কাছে। এসময় জহুরুল হক মুন্সী হাত তুলে বললেন এ চিঠি সে পৌঁছাবে হানাদার ক্যাম্পে। সাদা একটি পতাকা উড়িয়ে শার্টের পকেটে ক্লের এর চিঠি নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে পৌঁছান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বার্তা নিয়ে এসেছে শুনেই ওদের মাথায় রক্ত ওঠে গেল। এরপর সাথের সাদা পতাকা দিয়ে তার চোখ ও গামছা দিয়ে তার হাত বেঁধে ফেললো। জিপের পিছনে বসিয়ে স্পেয়ার চাকার সাথে শক্ত করে বাঁধা হলো তাকে। নিয়ে গেল জামালপুর শহরের পিটিআই চত্বরে লে. কর্নেল সুলতানের কাছে। চিঠি পড়ে লে. কর্ণেল সুলতান অপমানিত বোধ করেন তাই হাতের এসএমজি’র বাটের এক আঘাতেই তার মুখের উপরের পাটির চারটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলেন। জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানুষিক নির্যাতন করে তার কাছ থেকে কথা বের করার জন্য চেষ্টা চলতে থাকলো। চার ঘণ্টা উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। পাকিস্তানি একজন সেনা এসে পা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ‘মোরব্বা’র মতো করে ফেলে এবং হাতের আঙ্গুলে সুচ ঢুকিয়ে দেয়। আহত অবস্থায় বুদ্ধি করে অসহায়ের ভান করে জহুরুল হক মুন্সী জানায় যে সে একজন মুর্খ কৃষক। ক্ষেতে কাজ করার সময় ভারতীয় সেনারা বাধ্য করেছে এ চিঠি নিয়ে আসতে। এ চিঠি নিয়ে না গেলে তাকে গুলি করে মারার ভয়ও দেখায়। এতে দয়া হল সুলতানের। জহুরুল হক মুন্সীকে চা খেতে দেওয়া হয়। পরে সুলতান কলম বের করে ব্রিগ্রেডিয়ার ক্লের-এর চিঠির জবাব লেখেন। আত্মসমর্পণ না করার ইঙ্গিত হিসেবে ৭.৬২ মিলিমিটার চায়না রাইফেলের একটি বুলেট চিঠিটি দিয়ে মুড়িয়ে রাত নয়টার দিকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। জামালপুর গ্যারিসনে নির্যাতনের সময় কমান্ডার মুন্সী গ্যারিসন প্রধানের দোভাষী হিসেবে দেখতে পান, জামায়াতের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানকে।
মাঝরাতে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে ফিরে আসেন কমান্ডার মুন্সী। চিঠিসহ সে স্মারক পাওয়ার পরপরই পরদিন ১০ নভেম্বর মধ্যরাতের ঠিক আগ মুহূর্তে পরিকল্পনা অনুযায়ী জামালপুর গ্যারিসন দখলের জন্য আক্রমণ শুরু হয়। ১১ নভেম্বর সকাল ছয়টার দিকে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর দেখা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাকিস্তানি সেনাদের মৃতদেহ। পরাভব মেনে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী।
৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে যান মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের। সেখানে ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর ওই ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর ফজলে আকবর। সঙ্গে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জাইদি ও ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজরসহ আট জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। আরও ছিলেন বিভিন্ন পদমর্যাদার ৩৭১ জন সৈনিক। তাঁরা সবাই মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
জামালপুরের এই লড়াইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কর্মকর্তাসহ ২৩৪ জন নিহত হন। প্রাণ হারান মিত্রবাহিনীর ১০ জন সেনা। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয় বিভিন্ন ধরনের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র।
মেজর জেনারেল নাগরা এবং বিগ্রেডিয়ার ক্লেরসহ ভারতীয় সৈনিকরা বাংলাদেশের এক সাহসী আত্মপ্রত্যয়ী যুবকের দেশপ্রেম ও সাহস দেখে অভিভূত হন। জামালপুরের ওই লড়াইয়ের বর্ণনা পাওয়া যায় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের-এর ‘দ্য ব্যাটেল অব জামালপুর’ নিবন্ধে আর লে. কর্ণেল সুলতান মাহমুদ-এর লেখা ‘দ্য ষ্টোলেন ভিক্টরি’ গ্রন্থে।
এখানে আর একটু উল্লেখ না করলেই নয় যে, লে. কর্ণেল সুলতান মাহমুদও জহুরুল হক মুন্সী বীর প্রতীক (বার) এর মতো একই বীরত্ব পদক ‘সিতারা-ই-জুররাত’ দুইবার পান। প্রথমবার ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর সীমান্তে ক্যাপ্টেন থাকাকালীন সময়ে আর দ্বিতীয়বার ১৯৭১ সালে জামালপুরের এই যুদ্ধের জন্য পদক পান।
৫ই ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে দশটায় চিকিৎসার জন্য শ্রীবর্দীতে থেকে ময়মনসিংহ নেয়ার পথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।