Friday, September 29, 2023
Homeজামালপুরএকাত্তরের অনন্য শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান

একাত্তরের অনন্য শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান

উৎপল কান্তি ধর : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম।
১৯৩৯ সাল। সারা পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল। ইংরেজদের অধীনে এই ভারত উপমহাদেশের ঢাকা নামের ভূখন্ডের মানুষগুলোও তখন যুদ্ধের আতঙ্কে আতঙ্কিত। এমনি যুদ্ধের মাঝে ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকা শহরের আগা সাদেক রোডের বাড়িতে জন্ম নেন মতিউর রহমান। মা সৈয়দা মোবারুকুন্নেসা। বাবা মৌলবি আব্দুস সামাদ। তিনি পেশায় ছিলেন ঢাকা কালেক্টর অফিসের সুপার।
নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে ছিল তাঁদের পৈত্রিক নিবাস। নয় ছেলে দুই মেয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া মতিউর ছিলেন অষ্টম। ছেলেবেলা থেকেই তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, দুরন্ত, ডানপিটে। ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাঝে ছিল প্রতিভার দ্যুতি।
মতিউরের বাবা ছেলের উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন। তিনি তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদা পি. এ. এফ স্কুলে ভর্তি করাতে চাইলেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যের কারণে বাঙালীদের সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীতে ভর্তি হওয়া ছিল খুবই কঠিন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বাছাই করা স্কুলের বাছাই করা ছাত্রদের মাঝে পরীক্ষা হলো ইংরেজি মাধ্যমে। ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে মেধাবী মতিউর ১৯৫৬ সালে সারগোদা পি. এ. এফ একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন।
পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন জায়গায়, অচেনা পরিবেশে পাকিস্তানী সহপাঠীদের অসহযোগিতার মাঝে মতিউরের সময় কাটতে লাগল। তিনি কখনোই উর্দু ব্যবহার করতেন না। ডাইনিং হলে খাবার খাওয়া নিয়েও অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সহ্য করতে হতো তাঁকে। কিন্তু তিনি তাঁর মেধা দিয়ে, সীমাহীন সহ্যশক্তি আর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার দুর্বার আকাক্সক্ষা দিয়ে সকল প্রতিকূলতা জয় করার চেষ্টা করেন। প্রথম পরীক্ষাতেই সবার জবাব দিয়ে দিলেন তিনি। খেলাধুলায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন। ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল ও সাঁতারে সবাইকে অবাক করে দিলেন তাঁর ক্রীড়ানৈপুণ্যে।
১৯৬০ সালের মে মাসে মতিউর কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে মেট্রিক পাস করলেন ডিস্টিংশনসহ। এরপর দিলেন ওঝঝই বীধস. এরপর ১৯৬১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে তিনি রিসালপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন জিডি পাইলট কোর্সে। পাকিস্তানীরা সবসময়ই তাঁকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। বিমান নিয়ে পাকিস্তানী পাইলটের সাথে ডগ ফাইট করতে গিয়ে সাজাও ভোগ করেছেন মতিউর। কিন্তু তবুও মতিউর ছিলেন একজন চৌকস ক্যাডেট। তাঁর একাগ্রতা, ইচ্ছা আর মেধার কাছে প্রতিহত হলো সকল বিপত্তি। এগিয়ে গেলেন তিনি।
১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়ে পদোন্নতি হয় মতিউর রহমানের। ১৯৬৮ সালের ১৯ এপ্রিল বিয়ে করেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে মিলি খানকে। বিয়ের কয়েকদিন পরেই মতিউর চলে যান পাকিস্তানের চাকলালা বিমান ঘাঁটিতে। ১৯৬৯ সালের ২৩ এপ্রিল জন্ম হয় এ দম্পতির প্রথম কন্যা মাহিনের। পরের বছর ১৪ ডিসেম্বর জন্ম হয় দ্বিতীয় সস্তান তুহিনের।
১৯৭১ সালের শুরুতে সারাদেশ যখন উত্তাল, ছুটিতে সপরিবারে ঢাকা আসেন মতিউর রহমান। ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভায় যোগ দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এবং জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে তাঁর মনে হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে আর অখ-রূপে টিকে থাকা সম্ভব হবে না, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে।
২৫ মার্চ সকালে তিনি দাদা বাড়ী রায়পুরের রামনগর গ্রামে যান। অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংসতার পর মতিউর অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানী বিমান বাহিনী ‘সেভর জেড’ বিমান থেকে তাঁর গড়ে তোলা সেই ট্রেনিং ক্যাম্প ও প্রতিরোধ বাহিনীর ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে। মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন। তাই আক্রমণের পূর্বেই ঘাঁটি পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর বাহিনী।
বিমান আক্রমণ শেষে মতিউর সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বিমান থেকে ভৈরবে বোমাবর্ষণ হয়েছে। পাইলটদের মাঝে এমনও হতে পারে কেউ আমার ছাত্র। আমারই ছাত্র আজ আমার মাথায় বোমা ফেলছে। আমার দেশকে রক্তাক্ত করছে।’ মতিউর মাটি হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার নিজের মাটির মর্যাদা আমি রাখবোই। আমি পাইলট। আমার চাই যুদ্ধবিমান। একটা বিমান পেলে তাদের দেখিয়ে দিতাম। কারণ বিমান প্রতিহত করতে চাই বিমান বা বিমান বিধ্বংসী কামান।’
অসহযোগ আন্দোলনের একটা বড় সময় তিনি ঢাকায় অবস্থানরত বাঙালী বিমানবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করেন বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার উইং কমান্ডার এম কে বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার এম সদরুদ্দীন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহসহ বিমানবাহিনীর আরও কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সঙ্গে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বিমানবাহিনীর ১৮ জন বাঙালী অফিসার এবং প্রায় ৫০ জন টেকনিশিয়ান ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন।
এরপর মতিউর ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষে ঢাকা আসার পর পরিবারের মুরুব্বীদের চাপে ৯ মে করাচি ফিরে যান। যদিও দুই মাসের ছুটিতে এসে চারমাস পেরিয়ে গেছে ততদিনে। করাচি পৌঁছে মতিউর লক্ষ্য করেন বাঙালী অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তাঁকেও তাঁর নিজের দায়িত্ব না দিয়ে দেয়া হলো ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব। মতিউরের চিন্তা তখন কেবল একটি বিমানের। তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন। সহকর্মীদের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন আর খুঁজছেন সুযোগ।
পি.আই.এ-এর একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বাঙালী অফিসারদের উপর কড়া নজর রাখা শুরু হয়। বাঙালী পাইলটদের আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি বাতিল করা হয়। মতিউর তখন করাচির মশরুর বিমান ঘাঁটির বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসার। এর আগে মতিউর ছিলেন ফ্লাইট ইন্সট্রাকটর। ছাত্রদের বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি।
২০ আগস্ট শুক্রবার রাশেদ মিনহাজ নামে তাঁর এক অধ:স্তন অফিসার একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মতিউর সেটা ছিনতাই করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় কন্ট্রোল টাওয়ারে দায়িত্বরত ছিলেন ফরিদউজ্জামান নামের একজন বাঙালী অফিসার এবং একজন পাকিস্তানি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর বিমানটি নিয়ে ২৭ নম্বর রানওয়েতে ঢোকার জন্য ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্র্যাক দিয়ে এগিয়ে যান। মতিউর তখন তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে দ্রুত সেখানে চলে যান এবং রাশেদ মিনহাজকে থামার সংকেত দেন। মতিউর ছিলেন ফ্লাইট সেফটি অফিসার; কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও ফ্লাইট সেফটি অফিসার বিমান থামানোর সংকেত দিলে সেই নির্দেশ পালন করাই নিয়ম। রাশেদ মিনহাজ ট্যাক্সি ট্র্যাকের মাঝখানে বিমানটি দাঁড় করিয়ে বিমানের ক্যানোপি তুলে মতিউরকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হয়েছে ? তখন মতিউর লাফ দিয়ে বিমানটির ককপিটে উঠে পড়েন।
কেউ কেউ বলেন, মতিউর রাশেদ মিনহাজকে চেতনানাশক দিয়ে সংজ্ঞাহীন করে বিমানটি চালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে উড়ে যেতে থাকেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর রাশেদ মিনহাজ সংজ্ঞা ফিরে পান এবং দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ফলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে দুজনই মারা যান।
ভারত সীমান্তের কাছে তালাহার নামের একটি জায়গায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে বিমানের দুজন আরোহীই মারা গেছেন। রাশেদ মিনহাজের দেহ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং মতিউর রহমানের দেহ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দাফন হয়েছিল পাকিস্তানের করাচির মাশরুর বেসের চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে। কবরের সামনে লেখা ছিল, ‘ইধার শো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার’।
তাঁর স্ত্রী মিলি রহমানকে একটা বাড়িতে অন্তরীণ করা হয়, দিনের পর দিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৫ জুন তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনা হয়। ২৬ জুন মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। দীর্ঘ ৩৫ বছর অবহেলায় থাকলেও মতিউর ফিরে আসেন তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে। ঠাঁই পান এদেশের মাটিতে।
মতিউর রহমান তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা কতটা ব্যাকুল আর উদগ্রীব ছিলেন। এই নির্ভীক বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments