Friday, September 29, 2023
Homeজামালপুরএকাত্তরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ শরাফত আলী

একাত্তরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ শরাফত আলী

উৎপল কান্তি ধর : কুমিল্লা জেলার সদর থানার দক্ষিণ রামপুর গ্রামে ১৯৪৩ সালে জন্ম নেয়া এই মেধাবী ছেলেটি ১৯৬০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, দুই বছর পর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এবং একই কলেজ থেকে নেন বিএসসি ডিগ্রি ১৯৬৪ সালে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে গণিত বিভাগে ভর্তি হন।
প্রথম পর্ব পরীক্ষায় মেধাবী শরাফত প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে এমএসসি শেষ বর্ষ পরীক্ষায় আর্থিক টানাপোড়েনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। পরে ১৯৬৭ সালে আবার পরীক্ষায় বসেন এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এবং এ বছরই গণিত বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যুক্ত হন তিনি। পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের স্বর্ণ পদক লাভ করেন।
অমায়িক আচরণ আর লাজুক প্রকৃতির জন্য সবার প্রিয় ছিলেন শরাফত আলী। অস্বচ্ছলতার কারণে এমএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। এটিও লজ্জায় বলতে পারেননি সহপাঠীর কাছে। কুমিল্লার এই অমায়িক মেধাবী ছেলেটিকেই একদিন বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে হলো। তাঁর রক্তই যেন হয়ে উঠল দেশের পতাকার লাল বৃত্ত।
১৯৬৭ সালে শরাফত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি শহীদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটর ছিলেন । থাকতেন তিনি শহীদুল্লাহ হলের খাবার ঘরের দোতালায় একটি কক্ষে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছোট ভাই ড.এম শহীদুল্লাহ (তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র, পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সহকারী অধ্যাপক, বর্তমানে ভিজিটিং প্রফেসর, ইলিনল ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ) কে দেশের বিরাজমান অবস্থা দেখে এক বন্ধুর সাথে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন “ মাস শেষে বেতন নিয়ে বাড়ী যাব ”। কিন্তু শরাফত আলীর আর বাড়ী যাওয়া সম্ভব হয়নি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। মুক্তির সংগ্রামে অটুট বাঙালি। তাঁদের দমাতে অপারেশন সার্চলাইট চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা। শরাফত আলী তাঁদের একজন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কামানের গোলা ছোড়ে তৎকালীন ঢাকা হলে (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল)। শরাফত আলীর পাশের রুমে থাকতেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদিম। তাঁর বাসায় আগুন ধরে যায়। ভোররাতে চুপি চুপি শরাফত আলী সেই আগুন নেভাতে যান। তাঁকে দেখে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। তারপর নৃশংসভাবে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে হত্যা করে।
তারপর তার লাশ টেনে বের করে ক্যাম্পাসের মাঠে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মাঠগুলি ভরে গিয়েছিল অনেকের মরদেহে। পাকিস্তানিরা তাদের কয়েকটিকে বুলডোজারের সাহায্যে কবর দিয়েছিল, কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে তার লাশ স্পর্শ করা হয়নি। তার লাশ সেখানেই পড়েছিল, পাকিস্তানিরা ঢাকা পৌরসভাকে লাশ সরিয়ে নেওয়ার এবং দাফন করার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত।
দুর্ভাগ্যক্রমে, পচে বিকৃত হওয়ায় তার মৃতদেহ ততক্ষণে সঠিকভাবে দাফনের জন্য কোনওভাবেই স্বীকৃতিযোগ্য ছিল না। ধারণা করা হয় আরও অনেকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। শরাফত আলী ছিলেন অবিবাহিত।
সেসময়ের গণআন্দোলনের প্রতিটি কর্মকান্ডে সক্রিয় এই শহীদের সম্মানার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের একটি ভবনের নাম রাখা হয় “ শহীদ শরাফত আলী ভবন ”।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে, শহিদুল্লাহ হলে, শিক্ষক ক্যাফেটেরিয়া, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহশালা ও জাতীয় যাদুঘরে তাঁর নাম এবং ছবি থাকলেও কুমিল্লায় কোন স্থাপনা নামকরণ করা হয়নি এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামে। ভবিষ্যতে শহীদ শরাফত আলীর নামে কুমিল্লায় কোন একটি স্থাপনা হবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments