উৎপল কান্তি ধর : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের অবদান স্বাধীনতা ও তার পূর্বের আন্দোলনে অতুলনীয়। যেমন মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা, ড. মজিবর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও আরো কয়েকজন। প্রথম ২ জনের অবদান আগে জানিয়েছি, আজ বলবো সুখরঞ্জন সমাদ্দারের কথা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি (ছাত্র শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র) নামকরন করা হয়েছে এই শিক্ষকের নামে, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
ভাষা বিভাগের অধীনে সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার।
নাজিম মাহমুদের জবানীতে তাঁর হত্যাকা-ের ঘটনা শোনা যাক :
“একাত্তর চৌদ্দই এপ্রিল সকাল। স্বাধীনতার পক্ষের জনগণের রক্তপানের প্রবল তৃষ্ণায় জীপভর্তি পাকসেনারা এলো ৭১ নম্বর দালানোর সামনে। ওই দালানোর নিচের তলায় একটি ফ্লাটে বাস করতেন ভাষা বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই দেশ ত্যাগ করলেও অধ্যাপক সমাদ্দার মাটি কামড়ে ছিলেন। কোথাও যাননি। কেন যাবেন। তিনি হয়ত জানতেন, তিনি নিরীহ নিরপরাধ, সাতে পাঁচে নেই নির্লিপ্ত সৎ নাগরিক। শুধুমাত্র বাঙালি হওয়াই যে পাকসেনাদের কাছে বড় অপরাধ এই সহজ কথাটি কি অধ্যাপক সমাদ্দার একেবারেই বোঝেন নি? না, তা নয়।
‘মরতে হয় দেশের মাটিতে মরবো। আমরা হয়ত বাঁচবো না। তবে এ দেশ একদিন স্বাধীন হবেই’। মৃত্যুর কদিন আগে এমন উচ্চারণ করেছিলেন অধ্যাপক সমাদ্দার। শুধু তাই নয়। গান পাগল এই মানুষটি জীবনের শেষ কদিন কান্না জড়ানো গলায় কেবলই গাইতেন- ‘আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। ‘ইধার কোঈ হিন্দু আদমি হ্যায়? ফেরীওয়ালার মতো হাঁকাহাঁকি করলো সেই পাকসেনার দল।
‘হিন্দু ইধার নেহি হ্যায়’-এই মিথ্যা উচ্চারণ করে সেদিন তাদের ফেরাতে চেষ্টা করলেন অধ্যাপক সমাদ্দারের অবাঙালি প্রতিবেশী, মনোবিজ্ঞান বিভাগের মহৎপ্রাণ অধ্যাপক মুহম্মদ জুনায়েদ।
কিন্তু রক্তপায়ী মানুষ কি আর সহজে শান্ত হয়, তাদের ঠেকানো যায়? শেষ রক্ষা তাই হয়নি। ‘সমাদ্দার নাম শুনে পাকসেনারা কিছু বুঝতে না পারলেও সবকিছু তাদের বাত্লে দেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ ড. মতিউর রহমান। এই অবাঙালী শিক্ষক তখন মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তি। অধ্যাপক সমাদ্দারকে তিনিই শনাক্ত করেন- এই তোমাদের শিকার। তারপর কতজনের কাছে ছুটে গেলেন শ্রীমতী চম্পা সমাদ্দার। তাঁর স্বামী কোথায়, কেউ বলেন না। এমন কি দুজন শনাক্তকারীও চুপ। ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন তাঁকে সান্তনা দেন-ঢাকায় আছেন তাঁর স্বামী।
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি, বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামে। তার বাবার নাম কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার, মায়ের নাম প্রফুল্লবালা সমাদ্দার। দুই ভাই ও তিন বােেনর মধ্যে সুখরঞ্জন ছিলেন সবার বড়। কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত ও খ্যাতিমান অধ্যাপক। ছাটেবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের খ্যাতি ছিল। স্থানীয় বাইশারী স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি বরিশাল ব্রজমাহেন কলেজ (বি. এম. কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আই. এ. পাস করেন। বাবা কার্তিকচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পড়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনার্স কোর্স ছিল দুই বছরের।
১৯৫৮ সালে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ডিগ্রি পান। কিন্তু ততদিনে ভারতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নানা বিধি-নিষেধ আরাপে করা হয়। ফলে সুখরঞ্জন সমাদ্দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিষয়ে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে এম. এ. পূর্বভাগ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণি পান এবং ১৯৬১ সালে এম. এ. চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পান।
অনার্স পাসের পর সুখরঞ্জন প্রথমে কিছুদিন গোপালগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৫৯ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মানুষ হিসাবে তার খ্যাতি ছিল। তিনি সঙ্গীতচর্চা করতেন। একাত্তরের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাড়ার ৭১/বি নম্বর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাসের জুবেরী ভবন তখন মিনি ক্যান্টনমেন্ট। সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে প্রথমে জুবেরী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেনারা তাকে হত্যা করে বিনাদেপুরের এক দিঘির পাড়ে ফেলে রাখে। অসহায় চম্পা সমাদ্দার ছুটে গিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হােেসনের কাছে তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে। ড. সাজ্জাদ হােেসন তার অপারগতার কথা জানিয়ে দেন। নানা জায়গায় ছুটাছুটি করে চম্পা সমাদ্দার স্বামীর প্রকৃত অবস্থান জানার চেষ্টা করেন, কিন্তু খবর মেলেনি। তবুও তিনি আশায় বুক বেঁধেছিলেন। জুলাইয়ের গাড়োর দিকে চম্পা সমাদ্দারের সমস্ত আশাভরসার করুণ পরিণতি ঘটে। একজন প্রতিবেশী সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্যান্ডেল, ভাঙা চশমা চম্পা সমাদ্দারের হাতে স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে পৌছে দেন। চম্পা সমাদ্দার নিশ্চিত হন, তাঁর স্বামী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।
এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তার স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন ১৩ এপ্রিল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহরে ঢুকে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত একজন বাঙালি ই, পি, আর, সেনা (মুক্তিযাদ্ধো) অন্ধকারে চুপি চুপি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসার পেছনে এসে পানি চাচ্ছিল। আমার স্বামী তাকে নিজ হাতে পানি খাওয়ান। ওই ই. পি. আর. সেনাকে আশ্রয় দিলে বিপদ হতে পারে জেনেও তাকে আশ্রয় দেন। তাঁর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার স্বামী নিজ হাতে সে ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে সারা রাত তার সেবা করেন। রাত ৪টার পর ওই যুদ্ধে চলে যান।
পরদিন ১৪ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে হানাদার সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন অবাঙালি চেয়ারম্যান সৈয়দ মতিউর রহমানের ইঙ্গিতেই আমার স্বামী গ্রেফতার হন। হানাদার বাহিনীর ঘাতকেরা তাঁকে সেদিনই নির্মমভাবে হত্যা করে বিনোদপুরে ফেলে রেখে যায়। এটা তখন আমি জানতাম না। পরে জেনেছি। আমাদের বাসায় প্রতিদিন দুধ দিতেন এক ঘোষ। তিনি বিনোদপুরে এক দিঘিরপাড়ে আমার স্বামীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি আমার স্বামীর মৃতদেহ তাঁর কাজলার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উঠোনে মাটিচাপা দিয়ে রাখেন। তিনি সেদিনই পরিবারসহ ভারতে চলে যান। ফলে আমাকে খবর দিতে পারেননি। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে তিনি ঘটনাটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান। তখন কর্তৃপক্ষ তার দেহাবশেষ সেখান থেকে তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। পুনঃসমাহিত করে।
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের চাকরির মেয়াদ ১০ বছর পূর্ণ না হওয়ায় চম্পা তাঁর স্বামীর পেনশন বা এককালীন কোনো ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। এমনকি সরকারি কোনো অনুদানও তিনি পাননি। চম্পা তখন ম্যাট্রিক পাস ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদের কাছে চাকরির জন্য সাহায্য চাইলে তিনি চম্পাকে পড়াশানো করতে অনুপ্রেরণা দেন। উপাচার্য বললেন, ‘এই যোগ্যতায় যে চাকরি দেওয়া যায়, সেটি দিয়ে আমি আপনাকে ছোট করতে পারব না। আপনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। পরে আপনাকে চাকরি দেব।’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ৯০০ টাকা করে ভাতা বরাদ্দ করে। এভাবেই চম্পা সমাদ্দার এম, এ. পর্যন্ত পড়াশানো করেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে সহকারী হাউস টিউটর হিসাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চাকরি করে অবসর নেন। সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও চম্পা সমাদ্দারের বিয়ে হয় ১৯৬৩ সালে (২৭ ফাগুন)। তাদের সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়। ছেলে সলিলরঞ্জন সমাদ্দার চিকিৎসক, মেয়ে মল্লিকা সমাদ্দার ও সুস্মিতা সমাদ্দার দুজনই শিক্ষকতা করেন। ছবিতে ৩৩ বছর বয়সে প্রাণ হারানো দেশপ্রেমিক শিক্ষক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, তাঁর স্ত্রী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি তাঁর নামের।