Friday, September 29, 2023
Homeজামালপুরএকাত্তরের বুদ্ধিজীবি শহীদ রাশিদুল হাসান ও শহীদ আনোয়ার পাশা

একাত্তরের বুদ্ধিজীবি শহীদ রাশিদুল হাসান ও শহীদ আনোয়ার পাশা

সীমান্ত দাস : শহীদ বুদ্ধিজীবি রাশিদুল হাসানের কন্যা বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রোকাইয়া হাসিনা নীলির কাহিনী-
সকাল সাড়ে নয়টা, দুই অধ্যাপক বন্ধু বসে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে গল্প করছে, এমন সময় দরজায় করাঘাত …
ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক রাশিদুল হাসান আর বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ছিলেন ছেলেবেলার বন্ধু। সেই মুর্শিদাবাদে তাঁরা একসাথে স্কুলে পড়েছেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে একসাথে শিক্ষকতা করেছেন, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একসাথে অধ্যাপনা করতেন।
তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে থাকতেন পাশাপাশি দুটি ফ্লাটে। দুই পরিবারের মাঝে ছিল অবাধ মেলামেশা।
১৯৭১ সাল, ডিসেম্বর মাসে রাতে ব্ল্যাকআউট চলছে। আলো যাতে বাইরে না যায় সেজন্য জানালায়… ভেন্টলেটারে সাঁটা হচ্ছে কালো কাগজ। তো সন্ধ্যার পর রাশিদুল হাসানের পরিবার রোজই পাশের ফ্লাটে আনোয়ার পাশার বাড়িতে চলে যায়। মহিলারা পান খেতে খেতে গল্প করেন, দুই পরিবারের বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে খেলাধূলা করে আর দুই বন্ধু ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ শোনেন। এরই মাঝে দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা হয়, স্বাধীনতার আর দেরি নাই সেই বিষয়েও কথা হয়।সারারাত তাঁরা কথা বলেই কাটান, সকালে নিজেদের ফ্লাটে ফিরে আসেন। এইভাবেই কাটছিলো দিনগুলি।
১৪ই ডিসেম্বর সকালে আনোয়ার পাশার স্ত্রী আর উনাদের যেতে দেননি। বললেন রোজই চলে যান, আজ সকালের নাস্তায় খিচুড়ি আর ডিমভাজি করি, খেয়ে যান। নাস্তা খাওয়া শেষে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দুইবন্ধু যখন কথা বলছিলেন তখন দরজায় মুহুর্মুহু ধাক্কা পড়তে থাকে। দরজা খোলার পর দেখা গেল, মুখে কাপড় বাঁধা এবং মাথায় ক্যাপ পরা কয়েকজন মানুষকে, তারা আনোয়ার পাশার সাথে দেখা করতে চায় এবং বলে তাদের ‘স্যার’ তাঁকে তার সাথে দেখা করতে বলেছে।
বাড়িতে তিনি লুঙ্গি ও খদ্দরের চাঁদর পরে ছিলেন। সেটা বদলানোর সময়ও দেয়নি, বলে আধাঘন্টার মধ্যে ফেরত দিয়ে যাবে।
এমন সময় বন্ধু রাশিদুল হাসান এগিয়ে গিয়ে দেখেন বাইরে একজনের হাতে একটি কাগজ, (লিষ্ট) তিনি জিজ্ঞেস করেন, কে আপনাদের স্যার ?
তারা সে কথার জবাব না দিয়ে উল্টা তাঁর নাম জিজ্ঞেস করে, তিনি নাম বলার পর তারা বলে, আপনাকেও যেতে হবে। তাঁদের গায়ের খদ্দরের চাঁদর দিয়ে তাঁদের চোখ বেঁধে প্রায় টেনে হিঁচড়ে দুজনকে বাসে তোলা হয়।
এদিকে ততক্ষণে অন্দরমহলে খবর চলে গিয়েছে , তারা দৌড়ে এসে দেখলো একটা বাস, যার সারাগায়ে কাদা ল্যাপটানো। ভিতরে আরো মানুষ আছে কিন্তু তাদের দেখা যাচ্ছেনা। সেই বাসে করে তাঁদের দুজনকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলো কূখ্যাত আল বদর বাহিনীর লোকেরা।
দুই পরিবারে দুশ্চিন্তার শেষ নাই, বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেও তাদের কোন খবর পাওয়া গেলনা। ঘটনার বাইশ দিন পর সেই বাসের ড্রাইভার, (আল বদর বাহিনী যে বাসে করে তাঁদেরকে নিয়ে গিয়েছিলো) তাদের বাড়িতে এসে তাদেরকে ঘটনাটি জানায়। তাকেও সবার সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়েছিলো, কিন্তু সে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়।তাঁদেরকে আরো অনেকের সাথে মীরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে মারা হয়।পরে সেই জায়গাটিকে মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থান করা হয়েছে।
আপনজনেরা দ্রুত সেখানে পৌঁছায় …. বাইশ দিনে লাশ নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু আপনজনেরা তাঁদের কাপড় এবং ঘড়ি দেখে তাঁদেরকে চিহ্নিত করে।
এই কাজে বাংলাদেশীদের মধ্যে রাজাকার, আল বদর, আল শামস্ বাহিনীর সদস্যরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে, পাকিস্তানীদের দোসর হয়ে তারা নির্বিধায় এদেশের মানুষকে হত্যা করতে পিছপা হয়নি, স্বাধীনতার কিছুদিন আগে দেশ যখন স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চলেছে তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চিহ্নিত করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে মেতে ওঠে। মূলত বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদেরা এই সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।
ইতিহাসবিদরা এই দিনটিকে পৃথিবীর ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments