Friday, September 29, 2023
Homeজামালপুরএকাত্তরের শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ‘‘আমরা কবরে যাবো না। আমরা বাঁচবো’’

একাত্তরের শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ‘‘আমরা কবরে যাবো না। আমরা বাঁচবো’’

উৎপল কান্তি ধর : ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি কারাগারের যে কক্ষে বন্দি ছিলেন সেখানে অন্য রাজবন্দিদের মধ্যে ছিলেন মোজাফ্ফর আহমদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অজিত গুহ, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান আর অন্য কক্ষে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত সহ ষাট-সত্তর জন কমিউনিস্ট। দেখতে দেখতে একবছর গড়িয়ে ১৯৫৩ সাল এল। কমিউনিস্ট বন্দিরা জেলে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করতে চাইলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর পূর্বপরিচিত এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের সহকর্মী ছিলেন। তাই সবাই রণেশ দাশগুপ্তকে ধরলেন তাঁকে অনুরোধ করতে, তিনি যেন ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একটা নাটক লিখে দেন।
রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর কাছে গোপনে চিঠি পাঠালেন, জেলখানায় করার মতো একটি নাটক লিখে দেয়ার জন্য। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁকে জানালেন রাত ১০টার পর আলো নিভে গেলে নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। তিনি জেলখানার মধ্যে বসেই রচনা করলেন নাটক। যেসব ছাত্রবন্দী রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে লেখাপড়া করে তাদের ৮/১০টি হারিকেনের আলোয় মঞ্চ সাজিয়ে তাঁর লেখা নাটকটি সেদিন মঞ্চস্থ হয়েছিল।
এই নাটকটিই হলো ২১-এর অমর নাটক ‘কবর’। ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত ‘কবর’ই প্রথম সাহিত্যিক প্রতিবাদী প্রয়াস। রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে জেলখানায় বসেই যিনি এই নাটকটি লিখেছিলেন তিনি হলেন মুনীর চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রবন্ধিক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হওয়ার আর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা বাকি। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে পাকিস্তান সেনাদের। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রকে বঙ্গোপসাগরের নির্দিষ্ট জল সীমানা অতিক্রম না করার জন্য সাবধান করে দিয়েছে। রাও ফরমান আলী মার্কিন মুল্লুকের কর্ণধারদের সাথে যোগাযোগ করে আরজি জানিয়েছেন, পাক সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে ভালোয় ভালোয় চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিলে ওরা নাকি সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু পাকিস্তানীদের পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতার পরও যেন এ জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ জাতিকে মেধাশূন্য করাই ছিল পাকিস্তানী নরপশুদের মূল উদ্দেশ্য।
মা ছেলের জন্য ভাত বেড়েছেন। গরম ভাত থেকে ধোঁয়া উড়ছে। চুল না আঁচড়িয়েই খেতে বসতে যাবেন মুনীর চৌধুরী। ঠিক এই সময় একটা জিপ বাসার গেটে এসে থামল। জিপের আরোহীদের সবারই কালো কাপড় দিয়ে মাথা ও মুখ ঢাকা, চোখ দুটো কেবল দেখা যায়, চিনবার কোনো উপায় নেই।
কয়েকজন জিপ থেকে নেমে অনুমতির অপেক্ষা ছাড়াই বাসায় ঢুকে সরাসরি তাঁর কাছে গিয়ে একজন বলল, ‘আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে, আমাদের কমান্ডার আপনাকে যেতে বলেছেন।’
কথা শুনে মুহূর্তেই একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল পরিবারের সবার মাঝে। মুখঢাকা মানুষগু লোর কথা শুনে মা আগলে দাঁড়ালেন পথ। কিছুতেই যেতে দিবেন না ছেলেকে। ওদের একজন তখন বলল, ‘আপনারা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন, আমাদের কমান্ডারের সাথে দেখা করে এখুনি তিনি ফিরে আসবেন। আমরাই তো দিয়ে যাব।’
লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা ছিল তাঁর। পাজামা-পাঞ্জাবি পরতে ঘরের ভেতরে যেতে চাইলে সাথে সাথেই মুখঢাকা একজন বলে উঠল, ‘আর কিছুই গায়ে দিতে হবে না স্যার। আপনি কেবল যাবেন আর আসবেন।’ এক মুহূর্ত ভাবলেন তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে চলুন।’ বেরিয়ে গেলেন কালো কাপড় দিয়ে মুখঢাকা ওদের সাথে, যারা তাঁকে একেবারে নিয়ে যেতে এসেছিল।
পেছনে রেখে গেলেন মায়ের বাড়া গরম ভাত, মা, ভাইবোন, বিশ্ববিদ্যালয়, সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, স্ত্রী আর প্রিয় উত্তরাধিকার। আর ফিরে এলেন না তিনি। খুঁজেও পাওয়া যায়নি মুনীর চৌধুরীকে আর কোনোদিন।
জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর। মাবাবার দ্বিতীয় সন্তান মুনীর, বাবা আব্দুল হালিম চৌধুরী তখন মানিকগঞ্জ মহকুমার এস ডি ও। পৈত্রিক ভিটা নোয়াখালী জেলায় রামগঞ্জ থানার গোপাইরবাগ গ্রামে। মুনীর চৌধুরীর মা আফিয়া বেগম। ১৪ ভাইবোনদের মধ্যে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী এবং অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের নাম আমরা সকলেই জানি ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই মুনীর চৌধুরী সাহিত্যচর্চা, নাট্য কর্ম, বামপন্থী রাজনীতি একই সাথে চলিয়ে যান। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক খড়গ দিয়ে ভাগ করা হয়েছে ভারতকে। জন্ম হয়েছে পাকিস্তান নামের এক নতুন রাষ্ট্রের। পাকিস্তানের আবার দুই ভাগ, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। চারদিকে ষড়যন্ত্র, বঞ্চনা নিপীড়ন, পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে হাটে ঘাটে মাঠে ময়দানে কাজ করে যাচ্ছে শত শত নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা ।
তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য- নাট্যকর্মের মধ্যে আজ থাকবে শুধুই কবর নিয়ে কথা ! ভাষা-আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণে নিহতদের রাতা রাতি কবর দেওয়ার জন্য, রাজনৈতিক হাঙ্গামা কৌশলে এড়ানোর জন্য, শাসকগোষ্ঠী ছিন্নভিন্ন মৃতদেহগুলিকে পুঁতে ফেলতে চাইলে ইসলামধর্মের রীতিবিরোধী বলে গোর-খুঁড়েরা আপত্তি তোলে; আর বারুদের গন্ধ থাকায় এ লাশ কবর দেয়া উচিৎ হবে না বলে মত দেয় মুর্দা ফকির। এমতাবস্থায় বিপাকে পড়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার এবং নেতা। পুলিশ-অফিসারের নির্মোহতা এবং নেতার অতিরিক্ত মদ্যপান জনিত ভারসাম্যহীনতা ও ভীতির পরিবেশে নাটকের আবহ প্রবম্বিত হয়, লাশগুলি সমবেতভাবে প্রতিবাদ জানায়, তারা কবরে যাবে না তারা বাঁচতে চায় ! নেতা ও পুলিশ-ইন্সপেক্টর তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করে, ভয় দেখায়, আস্বস্ত করতে চায়; কিন্তু লাশেরা নাছোরবান্দা।
তৎকালীন ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ও তাদের তাঁবেদারদের নির্মমতা- বিশ্বাসঘাতকতা-মিথ্যাচারিতা আর ক্ষমতার প্রতি অপরিসীম লোভ উঠে আসে, ‘পুঁতে ফেল। দশ-পনেরো বিশ-পঁচিশ হাত যত নিচে পারো। একেবারে পাতাল পর্যন্ত খুঁড়তে বলে দাও। পাথর দিয়ে, মাটি দিয়ে, ভরাট করে গেঁথে ফেল। কোনদিন যেন আর ওপরে উঠতে না পারে। কেউ যেন টেনে ওপরে তুলতে না পারে, যেন চ্যাঁচাতে ভুলে যায়।’
কে যেন বলেছিলেন, যে, মুনীর চৌধুরীর অন্তঃপটে পূর্ণাভ হ’য়েছিলো মনুষ্যত্বের মাঙ্গলিক সংবিধান। আর আলথুসার বলেন, ‘শিল্পের ব্যতিক্রমী দিকটি হলো এটি “আমাদেরকে দেখায়” (মেক আস সি), “আমাদেরকে অনুধাবন করায়” (মেক আস পারসিভ), “আমাদেরকে অনুভব করায়” (মেক আস ফিল) এমন কিছু যা বাস্তবকে পরোক্ষে ইঙ্গিত করে।” নিচের আরেকটু অংশ যা দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় আশপাশের গা ঘিনঘিনে চেনামুখ যাদের মাধ্যমে আমরা জানি যে অর্থ আর ক্ষমতাই সবকিছুর মাপকাঠি !
“নেতা : দেখ ছেলে, আমার বয়স হয়েছে। তোমার মুরব্বিরাও আমাকে মানে। বহুকাল থেকে এ দেশের রাজনীতি আঙ্গুলে টিপে টিপে গড়েছি, শেপ দিয়েছি। কওমের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের, বলতে পার, আমিই একচ্ছত্র মালিক। কোটি কোটি লোক আমার হুকুমে ওঠে বসে।
মূর্তি : কবরে যাব না।
নেতা: আগে কথাটা ভালো করে শোন। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, শিক্ষিত ছেলে। চেষ্টা করলেই আমার কথা বুঝতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চেয়ে উঁচু ক্লাসে উঠেছ। অনেক কেতাব পড়েছ। তোমার মাথা আছে।
মূর্তি : ছিল। এখন নেই, খুলিই নেই। উড়ে গেছে। ভেতরে যা ছিল, রাস্তায় ছিটকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
নেতা : জীবিত থাকতে তুমি দেশের আইন মানতে চাওনি। মরে গিয়ে তুমি এখন পরপারে কানুনকেও অবজ্ঞা করতে চাও। কম্যুনিজমের প্রেতাত্মা তোমাকে ভর করেছে, তাই মরে গিয়েও এখন তুমি কবরে যেতে চাও না। তোমার মত ছেলেরা দেশের মরণ ডেকে আনবে। সকল সর্বনাম না দেখে বুঝি কবরে গিয়েও শান্ত থাকতে পারছো না। তোমাকে দেশের নামে, কওমের নামে, দ্বীনের নামে যারা এখন মরেনি, তাদের নামে মিনতি করছি তুমি যাও, যাও, যাও।
মূর্তি : আমি বাঁচবো।
নেতা : কি লাভ তোমার বেঁচে? অশান্তি ডেকে আনা ছাড়া তোমার বেঁচে কি লাভ? তুমি বেঁচে থাকলে বারবার দেশে আগুন জ্বলে উঠবে, সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার না করে সে আগুন নিভবে না। তার চেয়ে লক্ষী ছেলের মত কবরে চলে যাও। দেখবে দু’দিনেই সব শান্ত হয়ে যাবে। দেশের সুখ ফিরে আসবে।
মূর্তি মাথা নাড়ে
নেতা : আমি ওয়াদা করছি তোমাদের দাবী অক্ষরে অক্ষরে আমরা মিটিয়ে দেবো। তোমার নামে মনুমেন্ট গড়ে দেবো। তোমার দাবী এ্যাসেম্বীলিতে পাশ করিয়ে নেবো। দেশ জোড়া তোমার জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করবো। যা বলতে তাই করবো।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments