‘পলো বাওয়া উৎসব’ গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্য। আগে এই উৎসব সচরাচর দেখা গেলেও বর্তমানে তা খুব একটা দেখা যায় না। তবে শতবর্ষী এ পলো বওয়া উৎসব এখনো দেখা যায় নরসিংদীর রায়পুরায়। উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের খলিলাবাদ গ্রামে এক শ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এ পলো বাওয়া উৎসব।
প্রতিবছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসের কোনো একদিন এই উৎসবটি পালন করতে দেখা যায়। এ উৎসবে পার্শ্ববর্তী জেলার লোকজনও অংশ নেন।
এ বছর আজ বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) দুপুরে খলিলাবাদ ঐতিহ্যবাহী বিলে এ উৎসব পালন করতে দেখা গেছে। উৎসবে কিশোর থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধও অংশ নেন।
সরেজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খলিলাবাদের এ বিলে প্রায় এক শ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে এ পলো বাওয়া উৎসব। পলাশতলী ইউনিয়নের খলিলাবাদ গ্রামের খলিলাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে শতবর্ষী বিলটি এ ঐতিহ্য বহন করে আসছে। গ্রামের নাম অনুসারে বিলটি পরিচিতি লাভ করে ‘খলিলাবাদের বিল’ নামে। বিলে এ পলো উৎসবটি উপভোগ করতে পুরুষ, মহিলা, শিশু, কিশোর-কিশোরী সবাই বিলের পাড়ে উল্লাস করেন। এখানে নরসিংদী, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ি, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলার হাজারো মানুষ প্রতিবছর এ উৎসবে অংশ নেন।

খলিলাবাদ গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বসন্তের এ সময়টাতে আমার বাপ-দাদারা এ বিল থেকে বড় বড় রুই, কাতল, মৃগেল, শোল, বোয়াল, পুঁটিসহ প্রায় অর্ধশত প্রজাতির মাছ ধরতেন। এ বিলের মাছ অনেক সুস্বাদু। তাই তো এখনো পার্শ্ববর্তী ৫-৬টি জেলার প্রায় হাজারেরও বেশি মানুষ এ বিলে মাছ ধরতে আসেন। কেউ মাছ পায়, আবার কেউ পায় না। তবে সকলেই আনন্দের সঙ্গে হাসিমুখে এ উৎসবে অংশ নেন।
মাছ শিকারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উৎসবের সপ্তাহখানেক আগে পলো বাওয়া উৎসবে অংশ নেওয়া কোনো একজনের দায়িত্বে পার্শ্ববর্তী গ্রামে-গঞ্জের প্রতিটি বাজারে তৈলের টিন বাজিয়ে উৎসবের তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়। এমন খবর জানার পর লোকজন পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে পুরোনো পলোগুলো ধুয়েমুছে উৎসবে যাওয়ার জন্য তৈরি করে রাখে। আর যাদের পলো নষ্ট হয়ে গেছে তারা বাজার থেকে নতুন পলো ক্রয় করে উৎসবে অংশ নেয়। উৎসবের দিন সকালে নিজ নিজ পলো, হাতাজাল, উড়ালজাল ও লাঠিজালসহ নানা ধরনের মাছ ধরার জিনিসপত্র নিয়ে বিলের পাড়ে গিয়ে সমবেত হন শিকারিরা। ঘড়ির কাঁটায় নির্ধারিত সময় হলেই সবাই মিলে একসঙ্গে পলো নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
গাজীপুর থেকে আসা আহাম্মেদ আলী নামে ষাটোর্ধ্ব এক মাছ শিকারি বলেন, আমি গাজীপুর থেকে এসেছি। গত ৭ বছর যাবত এখানে মাছ শিকার করি। এবারও এসেছি। মাছ পাওয়া না পাওয়া বড় বিষয় না। সবাই মিলে আনন্দ করছি, হৈহুল্লোড় করছি। এখন পর্যন্ত দুটি গজার মাছ পেয়েছি। আশা করি আরও পাব।
ময়মনসিংহ থেকে আসা সোলায়মান নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমরা পাঁচজন এসেছি। আমি এখন পর্যন্ত একটি শোল মাছ পেয়েছি, আনন্দ লাগছে। বেঁচে থাকলে আগামীতেও আসব।
রাজবাড়ীর ফুলবাড়ি উপজেলার আনিস মিয়া বলেন, এখানে মাছ শিকার করতে আমরা দুইজন এসেছি। ৫ থেকে ৬ বছর যাবত আমি এখানে আসছি। সামনেও আসব।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ থেকে আসা মোবারক নামে আরেক মৎস্য শিকারি বলেন, আমি একটি বড় বোয়ালসহ কয়েকটি মাছ পেয়েছি। এতেই আমি খুশি। এটা শখের জিনিস। বাড়ি ফিরে পরিবার নিয়ে মজা করে খাব।
বেলাবো থেকে আসা ওয়াজিদ বলেন, আমরা ২০ থেকে ২৫ জন এসেছি। আমরা এখানে প্রতিবছরই আসি। এবার এসে বিভিন্ন জাতের মাছ পেয়েছি। খুবই ভালো লাগছে।
এ বিষয়ে পলাশতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া জানান, এই বিল সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রতিবছরই এই বিলে উৎসবমুখর পরিবেশে পলো বাওয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিতে বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক মৎস্য শিকারি আসেন।