উৎপলকান্তি ধর:
মুক্তিযুদ্ধাদের অসামান্য বীরত্বের কথা তো আমারা প্রায়ই শুনি। কিন্তু কখনো শোনা যায়না এই লোকটির কথা, যার সাথে বাঙালির, বাংলাদেশের কোন রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরও শুধুমাত্র বিবেকের দায় থেকে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। তিনিই একমাত্র বিদেশি, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভুষিত করা হয়।
ওডারল্যান্ড ছিলেন একজন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার। সেনাবাহিনীর থেকে অবসর নিয়ে তিনি ১৯৭০ সালে বাটা স্যু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেদারল্যান্ডস থেকে প্রথম ঢাকায় আসেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে তিনি কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক হন। তার কর্মস্থল ছিলো টঙ্গি। ১৯৭১ এর অপারেশন সার্চলাইটের ভয়াবহতা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে তিনি ভীষনভাবে মর্মাহত হন এবং বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। বাটার মত বহুজাতিক কোম্পানির অফিসার হওয়ার কারনে পশ্চিম পাকিস্তানে তার অবাধ জাতায়াত ছিলো। সেই সুযোগ নিয়ে তিনি ঢাকা সেনানিবাস এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় সামরিক অফিসারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর সাথে তার যোগাযোগ ছিলো। এছাড়াও তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ঔডারল্যান্ড বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কযেকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি বাঙালি যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেন। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি এদেশে ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্ব ভরে তিনি নিজ নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখতেন।