মোহাম্মদ আলী:
মসজিদ মাজার, অফিস আদালত, হাট বাজার, দোকানপাট, পাড়া মহল্লা, বাসা বাড়ীর, ট্রেণে বাসে কোথায় ভিক্ষুক নেই? প্রতিটি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুক। সম্প্রতি ভিক্ষুকদের সারিতে যুক্ত হয়েছে হিজড়া সম্প্রদায়। এদের যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। এদেরকে ভিক্ষা করতে বারন করা হলে বা ভিক্ষা না দিলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, কেউ কেউ অভিশাপ দেয়। এছাড়া বাসা বাড়িতে তাদের অবাধ গমনাগমনের ফলে মহামারিক আশঙ্কা রয়েছে করোনা ছড়িয়ে পড়ার। অথচ ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জামালপুর জেলার সাবেক জেলা প্রসাশক আহমদ কবীর জামালপুরকে ভিক্ষুকমুক্ত জেলা ঘোষণা করেছিলেন।
জামালপুর জেলা প্রসাশক কার্যালয়সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত জেলার ৭টি উপজেলার মোট ৩হাজার ৭শ ৭০জন ভিক্ষুককে পূণর্বাসন করা হয়েছে। কাউকে ভ্যানগাড়ী দিয়ে, কাউকে ছাগল দিয়ে, কাউকে দোকান করার জন্য পুঁজি দিয়ে আবার কাউকে ভিজিডি ও বয়স্কভাতার কার্ড দিয়ে। এতে ব্যয় হয়েছে ৯২ লাখ ৫৯ হাজার ৭শ ১১টাকা। এদের মধ্যে সদর উপজেলার ৮শ ৯৭জন, সরিষাবাড়ি ৩শ ৭৯জন, মাদারগঞ্জ ২শ ৩৭জন, মেলান্দহ ৪শ ২জন, ইসলামপুর ৬শ ৯০জন, দেওয়ানগঞ্জ ৮শ ৬৩জন, বকশিগঞ্জ ২শ ৩৬জন ভিক্ষুককে নানা সুবিধা ও জীবন যাপনের উপকরণের মাধ্যমে পূণর্বাসন করা হয়েছে।
তারপরেও প্রতিটি উপজেলার মসজিদ মাজার, অফিস আদালত, হাট বাজার, দোকানপাট, পাড়া মহল্লা, বাসা বাড়ী, ট্রেণে বাসে ভিক্ষুককদের ভিক্ষাবৃত্তি দেখা যায়। সোমবার ও বৃহস্পতিবারে তো ভিক্ষুকদের লাইন ছুটে। দলবেঁধে ভিক্ষুকরা বাড়ি বাড়ি প্রবেশ করে। এরা মানে না স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দুরত্ব। এতে করে একদিকে যেমন ভিক্ষাবৃত্তি উৎসাহ পাচ্ছে। আরেক দিকে করোনার মতো মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছে।
নুর ইলেক্ট্রনিকস এর সত্বাধিকারী নুরুল ইসলাম জানান, শুনেছি জামালপুর জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু কার্যতঃ তা দেখিনা। আমার মনে হয়, ভিক্ষুক কমেনি বরং বেড়েছে।
ইসলামপুর উপজেলার চরপুটিমারি ইউপি চেয়ারম্যান সুরুজ্জামান বলেন, যারা ভিক্ষা করে ভিক্ষাবৃত্তি তাদের স্বভাব। তারা ভিক্ষা করা ছাড়া থাকতে পারবে না।
মেলান্দহ উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাংবাদিক, আজম খান বলেন, সরকার যেভাবে ভিক্ষুক পূণর্বাসন করেছে তা ভিক্ষুকের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। একজন ভিক্ষুককে একটি ৩ কেজির ভিজিডি কার্ড দিয়ে পূণর্বাসন করা হয়েছে। সেই কার্ডের চালও নিয়মিত হয় না। কখনও ২মা ৩মাস পর দেওয়া হয়। ধরে নিলাম নিয়মিতই দেওয়া হয়। শুধু চাল খেয়েই একজন মানুষের জীবন ধারণ সম্ভব? এমতবস্থায়, ক্ষিধা লাগলে বা নগদ অর্থের প্রয়োজন হলেই তারা বাঁচার তাগিদে বেরিয়ে আসে হাত পাততে। আমার মতে জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে হলে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি চেয়ারম্যান মেম্বারদেও আরও আন্তরীক হতে হবে। গরীব দুঃখিদের জন্য যে বরাদ্দটি আসে তা যদি সঠিক ভাবে বিনা পয়সায় পায় তাহলে গরীবদের ভিক্ষাবৃত্তি করতে হবে না।
সদর উপজেলার কম্পুপুর গ্রামের করিমন (৫০) বলেন, আমি ৪০ বছর মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে করে খাই। গত ২০ বছর যাবত আমার জন্মান্ধ ছোট ভাইটিও আমার কাঁধে ভর করে ভিক্ষা করে। সপ্তাহে একদিন সোমবার আমরা ভিক্ষা করি। ওই একদিনে যা পাই তা দিয়ে আমাদেরকে ৬দিন বাঁচতে হয়। তারপরেও আমাদেরকে কোনো তালিকায় তালিকাভূক্ত করা হয়নি। এমতবস্থায় আমরা ভিক্ষা না করলে খাব কি?
আরেক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক গেইটপাড়ের মুছলিম উদ্দিন (৬৫) বলেন, ৪৫ বছর আগে পক্ষাঘাতে শারিরীক প্রতিবন্ধী হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে আছি। এরমধ্যে পূণর্বাসনের নামে বেশ কয়েকবার তালিকাভূক্ত হয়েছি, কিন্তু কখনও কোনো সুবিধা চোখে দেখিনি। যাদের পূণর্বাসিত করা হয়েছে তারাও নামমাত্র পেয়েছে। মাসে ৭ টাকা বা দুইটি ছাগল দিয়ে একটি ভিক্ষুক পরিবারকে পূণর্বাসন করা সম্ভব নয়, বলেও দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক (উপ-সচিব), মুহাম্মদ কবির উদ্দীন বলেন, ভিক্ষুক পূণর্বাসন একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কাজে এ প্রক্রিয়ায় কিছুটা ভাটা পড়েছিল। তবে, ইতিমধ্যে বর্তমান জেলা প্রশাসক ভিক্ষুকদের পূর্ণবাসনটির বিষয়টি নজরে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এবছর আরও ৭৫জন ভিক্ষুককে পূণর্বাসন করা হবে। আমরা উপজেলা পর্যায়ে তালিকা চেয়েছি। ভিক্ষুককের মাধ্যমে যাতে মহামারি করোনা ছড়িয়ে পড়তে না পারে আমরা সেদিকেও নজর রাখছি।
জামালপুর জেলা প্রসাশক. মুর্শেদা জামান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, প্রথমে ভিক্ষুকদের মানসিকতার পরিবর্তন আসতে হবে। তারা পূণর্বাসিত হয়েও যদি আবার পূর্বের পেশায় ফিরে আসে তাহলে প্রসাশন যত চেষ্টায় করুক না কেন লাভ হবে না। তারপরেও এবছর আবার আমরা ভিক্ষুক পূণর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ইতিমধ্যে সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নতুন তালিকা প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পূর্বে যাদেরকে পূণর্বাসন করা হয়েছিল তাদেরকেও যাচাই বাছাই করে স্থায়ী পূণর্বাসন করণ পরিকল্পনা রয়েছে। এব্যাপারে তিনি সবার সহযোগীতা কামণা করেছেন।