আ.জা. ডেক্স:
দেশের কোনো ডিজিটাল লেনদেনই সাইবার ঝুঁকিমুক্ত নয়। বিশেষ করে ম্যালওয়্যার আক্রান্ত মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারে আর্থিক লেনদেনে ব্যাংকিং খাতে সাইবার ঝুঁকি বাড়ছে। বর্তমানে যোগাযোগ ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক নানা সেবা নিতে স্মার্টফোন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহারও বেড়েছে। বর্তমানে গ্রাহকের কাছে থাকা স্মার্টফোনের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ওসব স্মার্টফোনের বেশির ভাগই ব্যবহার হচ্ছে। তবে নানা গবেষণার তথ্যানুযায়ী দেশে ব্যবহৃত স্মার্টফোনের উল্লেখযোগ্য অংশই ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত। আর ওসব ডিভাইসই দেশের ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের সাইবার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের সাইবার জগতের বিভিন্ন বিভাগেই নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানা দুর্বলতা রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে ম্যালওয়্যার দ্বারা মোবাইল ডিভাইস আক্রান্তের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দেশে ব্যবহৃত মোবাইলের ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশই বিভিন্ন ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তাছাড়া দেশের ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এ ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত। আর ওয়েবভিত্তিক ম্যালওয়্যার দ্বারা কম্পিউটার ডিভাইস আক্রান্তের হারে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। দেশের ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম্পিউটারই বিভিন্ন সময় ওসব ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। অন্তত একটি স্থানীয় ম্যালওয়্যারের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের ৩৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ কম্পিউটার। ওই ক্যাটাগরিতেও বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ব্যবহৃত ১৭ শতাংশের বেশি স্মার্টফোনই ম্যালওয়্যার আক্রান্ত। ম্যালওয়্যার আক্রমণের শিকারের তালিকায় কম্পিউটারও রয়েছে। আর দেশের বেশির ভাগ স্মার্টফোনেই এমএফএস কিংবা ব্যাংকিং সেবার অ্যাপ ব্যবহার হচ্ছে। ম্যালওয়্যার আক্রান্ত ডিভাইস দিয়েই গ্রাহকরা অ্যাপভিত্তিক অর্থ লেনদেন করছে। বাংলাদেশের কম্পিউটার ও মোবাইল উচ্চ সাইবার ঝুঁকিতে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার। কারণ এদেশের কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা সফটওয়্যার কিনে ব্যবহারে অভ্যন্ত নয়। ব্যবহৃত প্রায় সব কম্পিউটারই পাইরেটেড উইন্ডোজে পরিচালিত হয়। সেগুলোতে মানসম্মত অ্যান্টিভাইরাসও ব্যবহার হয় না। যে সফটওয়্যার নিজেই পাইরেটেড, তার পক্ষে ম্যালওয়্যার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
সূত্র আরো জানায়, দেশের ডিজিটাল লেনদেন উচ্চ সাইবার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিনিয়ত মোবাইল ও কম্পিউটারে অ্যাপ ব্যবহার করে আর্থিক খাতে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও অ্যাপভিত্তিক লেনদেনে জোর দিচ্ছে। এমন অবস্থায় মোবাইল ও কম্পিউটার সুরক্ষিত না হলে তা পুরো নেটওয়ার্ককেই দূষিত করে ফেলার আশঙ্কা থাকে। যদিও বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আর্থিক খাতে সাইবার হামলা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পনা জরুরি।
এদিকে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কম্পেয়ারটেক বিশ্বের ৭৫টি দেশের ওপর সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের গড় নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে ৩৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা গত বছরে ৩২ দশমিক ৪২ শতাংশ কভিড-১৯ সংক্রান্ত ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ম্যাকাফি সিকিউরিটির তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কভিড-১৯ সংক্রান্ত ৫ হাজার ৭৭৯টি ঝুঁকিপূর্ণ ই-মেইলের শিকার হয়েছে। আর ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে কম্পেয়ারটেকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল ব্যাংকিং ট্রোজান দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে দেশের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ব্যবহারকারী। দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মোবাইল ট্রোজান দ্বারা আক্রান্ত এবং শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আক্রান্ত হয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংকিং ম্যালওয়্যার দ্বারা। তাছাড়া টেলনেট আক্রমণের শিকার হয়েছে দেশের দশমিক ২৮ শতাংশ নেটওয়ার্ক। ক্রিপ্টোমাইনার্স দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ নেটওয়ার্ক। এসএসএইচভিত্তিক ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে দশমিক ২২ শতাংশ নেটওয়ার্ক। চলতি বছর কভিড-১৯ সংক্রান্ত ম্যালওয়্যার দিয়ে বিভিন্ন দেশেই আক্রমণ চালায় সাইবার অপরাধীরা।
অন্যদিকে দেশের আর্থিক খাতের প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টদের মতে, অ্যাপের মাধ্যমে ব্যাংক কিংবা এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মূল নেটওয়ার্কে সাইবার হামলার সুযোগ রয়েছে। কারণ গ্রাহকরা অ্যাপের মাধ্যমে নিজের ব্যাংক হিসাবের অর্থ লেনদেনের ক্ষমতা পায়। সেক্ষেত্রে ফোন যদি ম্যালওয়ার আক্রান্ত হয় তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কিংবা এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মূল নেটওয়ার্কে সাইবার হামলা চালানো সম্ভব। ব্যাংকগুলো নিজেদের সেবার তালিকায় নতুন নতুন অ্যাপ যুক্ত করছে। কিন্তু ওসব অ্যাপ ঝুঁকিমুক্ত কিনা তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানে না। ওসব অ্যাপ তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাইয়ের পর ব্যবহার করা জরুরি। পাশাপাশি ওয়েবসাইটগুলোতে প্রবেশ ও পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও গ্রাহকদের সতর্ক করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে দেশের ব্যাংক খাতের প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো তদারকির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায় জানান, কোনো ডিজিটাল লেনদেনই সাইবার ঝুঁকিমুক্ত নয়। যদিও ম্যালওয়্যার আক্রান্ত মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহার করে সাইবার হামলা করা তুলনামূলক সহজ। দেশের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপগুলো দিয়ে শুধু দেশের অভ্যন্তরে লেনদেন করা যায়। ওই বিচারে ম্যালওয়্যার আক্রান্ত স্মার্টফোনে এমএফএস অ্যাপ ব্যবহারে ঝুঁকি বেশি নয়। তবে দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন পর্যন্ত কোনো সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নেই। অথচ সাইবার সুরক্ষা পেতে হলে নিরাপত্তা উপকরণের ব্যবহার ও দক্ষ জনবল নিয়োগ জরুরি।