Friday, September 29, 2023
Homeস্বাস্থ্য‘লাঞ্ছনা-বঞ্চনায়’ অটিজম আক্রান্ত শিশুর বাবা-মায়েরা

‘লাঞ্ছনা-বঞ্চনায়’ অটিজম আক্রান্ত শিশুর বাবা-মায়েরা

তিন বছরের ছোট্ট ছেলে তাওসিফ। এখনও ঠিকমতো কথা বলতে শিখেনি। দুটি শব্দ ব্যবহার করে সে নিজ থেকে কোনও অর্থপূর্ণ বাক্য বলতে পারে না। তবে মাঝে মধ্যে অন্যের বলা কথা বারবার বলতে থাকে। নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না, সমবয়সীদের সঙ্গে মেশে না। বাবা-মায়ের চোখে চোখ রেখে তাকায় না। প্রতিদিন নিজস্ব রুটিন মেনে চলতে ভালোবাসে। রুটিনের ব্যতিক্রম হলে সে মন খারাপ করে বা রেগে যায়। মাঝে মধ্যে সে কোনও কারণ ছাড়াই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় শিশু তাওসিফ অটিজমে আক্রান্ত।

অটিজমে আক্রান্ত হলেও বাবা-মায়ের কাছে শিশু তাওসিফ অত্যন্ত আদরের। তবে অস্বাভাবিক আচরণের কারণে প্রতিবেশী-আত্মীয় স্বজনদের কাছে অনেকটা বিরক্তির কারণ। অস্বাভাবিক এই শিশুর প্রতি বিরক্তি অনেকটা নীরবে নিভৃতে সহ্য করতে হয় তাদের মা-বাবাকেও।

সমাজে এমন চিত্র শুধু তাওসিফ আর তার পরিবারেই নয়, অটিজমে আক্রান্ত প্রায় প্রতিটি পরিবারকেই এরকম নানা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় নিত্যদিন।

চিকিৎসকদের মতে, অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার শিশুদের স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা যেখানে শিশুর সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা, আশেপাশের পরিবেশ, ব্যক্তির সঙ্গে মৌলিক ও ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে যোগাযোগের সমস্যা এবং আচরণের পরিবর্তন দেখা যায়।

তাদের মতে, ধর্ম-বর্ণ-আর্থসামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে যেকোন শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় চার গুণ বেশি। সাধারণত শিশুর বয়স ৩ বছর হওয়ার আগেই (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৮ মাস থেকে ৩৮ মাস বয়সের মধ্যেই) অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।

dhakapost

৯ শতাংশ অটিজম শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার : গবেষণা

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ৯ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের টারশিয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অটিজমে আক্রান্ত ৪৫ শিশুর মায়েদের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখা যায়, ৩ থেকে ৯ বছর শিশুর প্রত্যেকেই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮.৯ শতাংশই কোনো না কোনো সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

একইসঙ্গে দেশের গ্রামীণ এলাকায় ১ হাজার ৪১৬ জন ১১-১৭ বছর বয়সী শিশুর ওপর পরিচালিত আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে বাড়িতে, স্কুলে এবং কর্মক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন, ১৭ শতাংশ মানসিক নির্যাতন এবং ৭৮ শতাংশ শিশু অবহেলার শিকার হয়েছে।

dhakapost

দেশে অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কত?

দেশে অটিজমে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ে নতুন কোনও গবেষণা বা জরিপ নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্টিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) চার বছর আগের তথ্য বলছে, প্রাপ্ত বয়স্কদের বাদেই দেশে তিন লাখের বেশি অটিজম আক্রান্ত শিশু রয়েছে। বর্তমানে সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। যাদের বয়স দেড় থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।

২০১৭ সালের জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ হাজার জনে ১৭ জন এ রোগে আক্রান্ত। তবে দুটি জরিপেই মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর সংখ্যা বেশি এবং গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তবে, ২০১৩ সালে পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রতি ১০ হাজার জনে ১৫ শিশু অটিজমে আক্রান্ত।

সরকারের ডিজঅ্যাবিলিটি ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ৭৮ হাজার ২১১ জন। তাদের মধ্যে ছেলে ৪৭ হাজার ৯১৪ জন, মেয়ে ৩০ হাজার ২৪১ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ৫৩ জন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে, হাসপাতালটির শিশু নিউরোলজি বিভাগে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ অটিজম শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। সে হিসেবে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি অটিজমে আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। জানা গেছে, বিএমএমএমইউ ছাড়াও সারা দেশের ৩৪টি মেডিকেলে অটিজমে আক্রান্তদের চিকিৎসায় একটি করে শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। এর বাইরে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ও প্রয়াসসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে কাজ করছে।

নগরায়ন-ছোট পরিবারে বাড়ছে অটিজম : অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অটিজম মনিটরিং সেলের পরিচালক ও বিএসএমএমইউ হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু বলেন, অটিজমে আক্রান্ত সংখ্যা দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এর প্রথমত কারণ হলো, অটিজম নিয়ে সচেতনতা বাড়ায় শনাক্ত এখন আগের তুলনায় বেশি হচ্ছে। একটা সময় আমাদের দেশে অটিজম নিয়ে কাজ করার মতো মানুষ খুবই কম ছিল। কিন্তু এখন এই সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অটিজম স্কুল হচ্ছে, এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় সাইকোলজিস্ট এবং থেরাপিস্টরা কাজ করছে।

তিনি বলেন, একটা সময় এধরনের সব রোগীকেই প্রতিবন্ধী এবং পাগল বলা হতো। এখন সেই পরিস্থিতি নেই, কারণ হলো অটিজম কোনটা বা পাগল কোনটা সেটা বোঝার মতো মানুষজন আসছে, হাসপাতালগুলোতে জনবল বেড়েছে এবং রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ২০১০ সালের একটি গবেষণা দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ৩ শতাংশ বাচ্চা অটিজমে আক্রান্ত। আর ঢাকার বাইরে এই আক্রান্তের হার দশমিক ০৭ শতাংশ। তখন বোঝা গেল অটিজম শহরাঞ্চলে বেশি, গ্রামে কম।

ডা. গোপেন কুমার বলেন, দেশে দিন দিন নগরায়ণের দিকে এগুচ্ছে, মানুষজন শহরমুখী হচ্ছে। শহরের মধ্যে বেশিরভাগ বাচ্চারাই থাকে একটা রুমের মধ্যে আবদ্ধ। ছোট পরিবারগুলোতে মানুষ কম থাকায় বাচ্চারা অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকে মোবাইল নিয়েই। অটিজমের পরিবেশগত কারণগুলোর মধ্যে এটা খুবই একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জিনগত সমস্যা কিছু থাকলেও পরিবেশগত সমস্যার কারণে অটিজমের মাত্রাটা আরও বেশি বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, মানুষ যত শহরমুখী হচ্ছে, বাচ্চাদের মা-বাবারা চাকরিতে ব্যস্ত হচ্ছে, অটিজমে আক্রান্তের ঝুঁকিও বেড়ে চলেছে। কারণ, ছোট বাচ্চাদের জন্য কনভারসেশনটা (কথাবার্তা বলা) হলো আসল। মৌখিক, ভাষাগত এবং ইশারাগত -এ তিনটি মাধ্যমের কোন ভাষাটাই আসে না শহুরে ছোট পরিবারগুলোর বাচ্চাদের। সবমিলিয়ে বলা যায়, যত বেশি নগরায়ণ হবে, পরিবারগুলো যত বেশি ছোট হতে থাকবে, চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সংখ্যা যতোই বাড়তে থাকবে, অটিজমে আক্রান্তের হার ততোই বাড়তে থাকবে।

ব্যক্তি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান

অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষ্যে এক শুভেচ্ছাবার্তায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অটিজম এবং এনডিডি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের যথাযথ পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আমাদের সমাজ ও পরিবারের অংশ। প্রতিবন্ধী ও এনডিডি (নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিস্যাবিলিটি) বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।

আবদুল হামিদ বলেন, অটিজম ও এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিদের জীবনব্যাপী সেবার প্রয়োজন হয়। তাই অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কাউন্সেলিং ও রেফারেল সেবা এবং সহায়ক উপকরণ ও সহায়ক প্রযুক্তি প্রদান করে আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে রয়েছেন এমন শিশু ও ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়েই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিসহ সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মানসিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ জীবন গঠনের পথকে আরো প্রসারিত করবে বলেও বিশ্বাস করেন।

সঠিক পরিচর্যা-শিক্ষায় অটিজমে আক্রান্তরা হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের সম্পদ

দিবসটি উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছাবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মানবিক পরিবেশে গড়ে তোলা হলে তারাও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে।

তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মানবিক পরিবেশে গড়ে তোলা হলে তারাও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে। সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়েই আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এনডিডি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় ‘জাতীয় কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা : ২০১৬-২০৩০’ প্রণয়ন করেছি। এর আওতায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাত্রা ও বয়সভিত্তিক জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্ট অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তির গৃহভিত্তিক পরিচর্যা ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য মাতা-পিতা ও অভিভাবককে অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এছাড়া এই সুরক্ষা ট্রাস্ট হটলাইনভিত্তিক মেডিকেল সেবা, ডিজিটাল টেলিমেডিসিন সেবা ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কারিকুলাম প্রণয়নের কাজ করছে।

প্রসঙ্গত, ১৬তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস আজ (২ এপ্রিল)। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গঠন’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments