Sunday, October 1, 2023
Homeশেরপুরশেরপুরের নদনদী নাব্য সংকটে

শেরপুরের নদনদী নাব্য সংকটে

শেরপুর সংবাদদাাদ : সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলা একসময় নদীমাতৃক জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রায় দেড় ডজন নদ-নদী ছিল এ জেলায়। কিন্তু দিন দিন নদীগুলো পড়েছে নাব্য, অস্ত্রিত্ব সংকটে। নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে অনেক নদী ও খাল-বিল, আবার অনেক নদীর গতিপথ পাল্টে গেছে। আবার কোন কোন নদীর বুকে চলছে দেদারসে আবাদ ফসল ও মাছের ঘের। নির্মাণ করা হয়েছে ঘর-বাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠান। যার কারণে মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার অবস্থায় রয়েছে নদীগুলো। জেলার প্রায় দেড়শ বছর আগের ইতিহাসে ১৬টি প্রধান নদী ও ৯টি ক্ষুদ্র নদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহাসিকবিভিন্ন গ্রন্থে যে ১৬টি প্রধান নদীর নাম উল্লিখিত আছে সেগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র নদ, মালিঝি নদী, সোমেশ্বরী নদী, মৃগী নদী, নেত্রবতী নদী, মহাঋষি নদী, থলঙ্গ নদী, ভোগবতী নদী, খারুয়া নদী, দর্শা নদী, ভুরাঘাট নদী, বলেশ্বরি নদী, সুতি নদী, মরাখড়িয়া নদী, বৃদ্ধ ভোগবতী নদী ও খড়িয়া নদী। এগুলোর নব্যতা হারিয়ে আটটি নদী এখনো কালের সাক্ষী হয়ে কোনোমতে বেঁচে রয়েছে। বাকি আটটি নদী এখন শুধুই ইতিহাস। যে আটটি নদী টিকে রয়েছে তারমধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদী, মৃগী নদী, সোমেশ্বরী নদী ও মালিঝি নদী পূর্ব নামেই এখনো পরিচিত। আর যে চারটি নদীর নাম পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো হলো- ভোগবতী থেকে ভোগাই নদী, মহাঋষি থেকে মহারশি নদী, থলঙ্গ থেকে চেল্লাখালি নদী এবং নেত্রবতী থেকে নেতাই নদী। অন্য নদীগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে। অপরদিকে ‘দশানি’ নামে নতুন একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে।
শেরপুরের ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ আকবরগ্রন্থ ‘নাগ বংশের ইতিবৃত্ত’ ও ‘শেরপুর টাউনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’বইসূত্রে জানা যায়, ১৮৮৫, ১৮৯৭ এবং ১৯১৮ সালে এই অঞ্চল জুড়ে প্রবল ভ’মিকম্প হয়। এর ফলে শেরপুরের বেশ কিছু নদ-নদী, খাল-বিল সমূহের গতি পরিবর্তিন ও ভরাট হয়ে যায়।
এক সময়ে মৃগী নদীতে ছিল অথৈ জল। শহরের পাশ্ব দিয়েই এ নদীটি বয়ে গেছে। এখানকার মানুষের প্রশান্তিরর স্থান ছিল এই নদী। কিন্তু নদীটি এখন আধুনিক পৌর শহরের বর্জ্যরে আস্থানা, জেলখানার পিছনে সাবেক লাশকাটা ঘরের পাশ্বে ফেলা হয় পৌর বর্জ্য। আবার শহরের বিশাল বিশাল ড্রেন নামিয়ে দেয়া হয়েছে মৃগী নদীর বুকে। যার কারণে বিলীন হয়ে গেছে নদীর সুস্বাদু মিঠা পানির মাছ।
চরশেরপুর ইউনিয়নের যোগিনীমুড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহ জাহান আলী বলেন, ছোটসময় আমরা এ নদীতে জলকেলি করেছি। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ধান পাট, গম ও মরিচ বোঝায় করে ব্যবসায়ীরা এ নদী দিয়ে তাদের মালামাল বহন করতো।
এক সময়ের বিখ্যাত নেতাই নদী দখল দূষণে নব্যতা হারিয়ে নেতাই খালে পরিণত হয়। পরবর্তীতে মানচিত্র থেকে একেবারেই হারিয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম এই নদীর নামও এখন আর জানে না। অথচ এই নদী সাবেক শেরপুর পরগণার মধ্যে ৪৩ মাইল দীর্ঘ নদ বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এ ছাড়া মৃগী নদীর দৈর্ঘ্য ২৯ মাইল, ব্রহ্মপুত্র নদ সাড়ে ১০ মাইল, মালিঝি নদী সাড়ে ৩৫ মাইল, চেল্লাখালি নদী ১২ মাইল, সোমেশ্বরী নদী সাড়ে ১৮ মাইল, মহারশি নদী ১৫ মাইল এবং ভোগাইনদী ১৬ মাইল দীর্ঘ ছিল। এখন নদীগুলো পরিমাপ করার অবস্থায় আর নেই। নাব্যতা হারিয়ে জৌলুস কমে গেছে এসব বড় বড় নদীর। নকলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতি নদীকে ঘিরে বৃটিশ আমলে চন্দ্রকোণায় গড়ে ওঠেছিল বিশাল বন্দর। সেসময় বিভিন্ন ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেই বন্দর। কিন্তু আজ সেই সুতি এখন প্রভাবশালীদেও ধানি জমি আর মৎস্য খামারে পরিণত হয়েছে।
নকলার কলাপাড়া গ্রামের ষাট্টোর্ধ মজিবুর রহমান জানান, একসময় সুতি নদী দিয়ে ট্রলার, বড় বড় নৌকা চলাচল করতো যা আমাদেও চোখের দেখা। সারাবছর পানিতে থৈ থে করতো। কিন্তু এখন দিনে দিনে আশেপাশের লোকজন নিজেদেও পজিশন মত দখল করে নিয়েছে নদীটি। দিনে দিনে ভরাট হয়ে দখলবাজদের ধানের ক্ষেতে ও মাছের ঘেরে পরিণত হয়েছে। একই গ্রামের উম্মে তাবাসসুম দিয়া বলেন, আমি আজই প্রথম শুনলাম এখানে নদী ছিল। কারণ জন্মের পর থেকেই দেখছি ধানের জমি। মাঝে মাঝে কারোর মাছের ঘের। আমি এ নদী খনন করে আগের নব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।
হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে শেরপুর-জামালপুর সীমারেখায় প্রবাহমান হয়েছে। এই ব্রহ্মপুত্র নদ শেরপুর-জামালপুরের চরাঞ্চলের আশীর্বাদ ছিল। কালের বিবর্তনে আজ নদীটি ছোট একটি বালু চরে পরিণত হয়েছে। সেখানেও দখলবাজদের চোখ পড়েছে। অন্যদিকে উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ব্রহ্মপুত্র, মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই, চেল্লাখালি নদীর স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ, সুইস গেট নির্মাণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চর জেগে ওঠে। আবার পাহাড়ি বিভিন্ন নদীতে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতি ও নব্যতা একেবারে হারিযে ফেলেছে।
নদী খননের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় নাব্যতা হারিয়ে নদীগুলো আজ প্রবাহহীন। নদীর বুকে জেগে ওঠেছে চর। সেই চরে চাষাবাদ করছে মানুষ। আবার কিছুকিছু জায়গায় গড়ে ওঠেছে ঘর-বাড়ি। নানা বিবর্তন পরিবর্তন প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে নাব্যতা হারানো নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সামান্য জলাধারে। এই নদীগুলোকে বাঁচাতে বিভিন্ন সংগঠন একাধিকবার দাবি জানালেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র ময়মনসিংহ বিভাগের সম্বনয়ক ইবনুল সাইয়্যিদ রানা বলেন, ‘শেরপুরের নদীগুলো খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে পাহাড়ি নদীগুলো পরিকল্পিত খনন করলে দুইদিকেই লাভ হবে, একদিকে নদীর নাব্যতা ফিরবে, অন্যদিকে খননের ফলে প্রাপ্ত বালু, নুড়ি মূল্যবান খনিজ সম্পদ হিসেবে বিক্রি করা যাবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় হবে।’
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম জনউদ্যোগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আযাদ বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষের অসচেতনতার কারণে নদী বা খালগুলোর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া নদ, নদী ও খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা দখল ও দূষণ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদী রক্ষায় শেরপুরে নানান কর্মসূচি পালন করেছি। আর এসব নদী রক্ষার্থে প্রশাসনের দ্রুত নজরদারির দাবি জানাচ্ছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের শেরপুরের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. শাহ জাহান বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ নদীই পাহাড়ি নদী। বিশেষ করে বন্যার সময় এসব নদীতে প্রচুর পলি আসে। যার ফলে নদীরগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। আর সেসব নদী খননের উদ্যোগ নিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর নদী ও জলাশয় দখলমুক্ত করতে জেলা প্রসাশনের সহায়তায় আমরা মাঝেমধ্যেই অভিযান করে থাকি।
শেরপুর জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, ‘নদী থেকে অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলন বন্ধে আমাদের নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা নকলার পেকুয়া বিলের দখল হয়ে যাওয়া প্রায় ১’শ একর জায়গা উদ্ধার করেছি। এছাড়াও ঝিনাইগাতীর ধলী বিলে প্রায় ৭০ একর জায়গা দখলবাজদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি। এ উদ্ধার অভিযান অব্যহত থাকবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments