উৎপল কান্তি ধর :কামালপুর রনাঙ্গণের অসামান্য এক কোম্পানী কমান্ডার সৈয়দ সাদরুজ্জামান হেলাল, বীর প্রতীক। কামালপুরের পাকিস্তানি সেনাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি প্রথম আক্রমণ করেন একাত্তরের আগস্টের সূচনায়, ৯ই আগস্ট। আর, তা শেষ হয় ৪ঠা ডিসেম্বর, কামালপুরের সেই দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বিজয় এবং পাকিস্তানি সেনাদলের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। সবমিলিয়ে সাদরুজ্জামান হেলালের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদলের কোম্পানী কামালপুর আক্রমণ করে ১৮ বারেরও বেশী। তাদের হাতে নিহত হয় হাজারের ওপর পাকিস্তানি সেনা। আর, যুদ্ধজয়ের এই অসামান্য সাফল্যের কারণে বীরবিক্রম, বীর প্রতীকসহ বিভিন্ন বীরত্ব সূচক খেতাবে ভূষিত করা হয় হেলাল কোম্পানীর অধিনায়ক সৈয়দ সাদরুজ্জামান হেলাল সহ এই কোম্পানীর সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। একটি একক মুক্তিযোদ্ধা দল বা কোম্পানীর ৭ জনের বীরত্বসূচক পদক প্রাপ্তি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক অধ্যায়।
মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অসামান্য এক অধিনায়ক ছিলেন কর্ণেল তাহের। কামালপুরের যুদ্ধে একাত্তরের ১৪ই নভেম্বর তাঁর এক পা হারান তিনি। সেদিনও, তাঁর প্রিয়ভাজন কোম্পানী কমান্ডার সাদরুজ্জামান হেলাল ছিলেন তাঁর পাশেই। গুরুতর আহত কর্ণেল তাহেরকে চিকিৎসার জন্যে ভারতীয় হেলিকপ্টারে তুলে দেন হেলাল।
কামালপুর রনাঙ্গণের অসামান্য এই যোদ্ধা সাদরুজ্জামান হেলাল কামালপুর ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন যুদ্ধ ও অপারেশনে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। উড়িয়ে দিয়েছেন ইসলামপুরের নাটুপুরের রেলওয়ে সেতু, ধ্বংস করেছেন শত্রুপক্ষের পাটের গুদাম।
কামালপুর রনাঙ্গণে মাস-কে-মাস ব্যাপী চলা লাগাতার এই যুদ্ধের কাহিনী আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক একাডেমিতে পড়ানো হয়। সেই দুধর্ষ যুদ্ধের অনন্যসাধারণ এক নায়ক সৈয়দ সাদরুজ্জামান হেলাল।
বর্তমানে, সত্তরোর্ধ হেলাল এক বিশিষ্ট পরিবারে জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালে, জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুট এলাকায়। পিতা সৈয়দ বদরুজ্জামান, মা সৈয়দ খোদেজা জামান। ৭ ভাইবোনের মধ্যে হেলালই বড়ো।
প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব সম্পন্ন হয় তাঁর কলাবাধা প্রাইমারী স্কুলে। ইসলামপুর নেকজাহান হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্ব শেষ করে ১৯৬৬ সালে ভর্তি হন জামালপুর শহরের আশেক মাহমুদ কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় তিনি ছিলেন স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র, বয়েস ২১।
কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই বাম-প্রগতিশীল ধারার অনন্য ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সক্রিয় কর্মীরূপে যুক্ত ছিলেন তিনি। এই সংগঠনের মহকুমা কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতিরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন।
৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যূত্থানে ছিলেন জামালপুরের অন্যতম ছাত্রনেতা। একই সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারী করলে জামালপুর শহরে ছাত্র ইউনিয়নের যে ১২ নেতা ‘মার্শাল ল’ ভঙ্গ করে প্রতিবাদী মিছিল করেছিলেন, হেলাল ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সামরিক ট্রাইবুনাল মার্শাল ল ভাঙ্গার দায়ে ৪ নেতাকে কঠিন বেত্রদন্ড ও কারাদন্ডে দন্ডিত করে।
৭১-এর ২৫শে মার্চের গণহত্যা শুরুর পর হেলাল জামালপুর শহরে জামালপুর হাই স্কুল মাঠে তরুণদের নিয়ে ডামি রাইফেলে সামরিক প্রশিক্ষণ করান। কলেজে পাওয়া পি,এন,সি,সি প্রশিক্ষণ তাঁর কাজে লাগে। পরবর্তীতে, তাঁর নিজ এলাকা দুরমুটেও তরুণদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
মে মাসের ৩য় সপ্তাহে সীমান্ত অতিক্রম করে পৌঁছেন ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে। যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। প্রথমে প্লাটুন কমান্ডার, পরবর্তীতে ১০০ জনের কোম্পানীর অধিনায়ক করা হয় তাঁকে। কোম্পানীর নাম হয় হেলাল কোম্পানী।
মেঘালয়ের তুরায় প্রশিক্ষণশেষে সেই কোম্পানীর যোদ্ধাদলের সদস্য দাঁড়ায় ১৭৪ জনে। যোদ্ধাদলের অধিকাংশই ছিলেন জামালপুরের ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ এবং ধানুয়া-কামালপুর এলাকার। তাই, এই যোদ্ধাদল নিয়োজিত হয় কামালপুর রনাঙ্গণে, আগস্টের সূচনা থেকে।
পাকিস্তানি সেনারা নানারকম ভাবে সুরক্ষিত ও শক্তিশালী করে তুলেছিল কামালপুর বিওপিকে। প্রায় দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়েছিল এই সেনা ঘাঁটিকে। চারদিকে কংক্রীটের সব বাঙ্কার, মোটা গাছের গুঁড়ি, নানান বুবি ট্র্যাপ ইত্যাদি দিয়ে খুবই শক্তিশালী করে তোলা হয়েছিল একে।
সেই দুর্ভেদ্য পাকিস্তানি সেনাঘাঁটির পতন হয় ৭১-এর ৪ঠা ডিসেম্বর। আত্মসমর্পণ করে সেনাঘাঁটির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আহসান মালিক সহ ১৬২ পাকসেনা, সঙ্গে রাজাকারদের এক কোম্পানী। একজন মহিলা ওয়ারলেস অপারেটর নূরজাহানও ছিল আত্মসমর্পণের সেই দলে।
কামালপুরে পাকিস্তানী সেনাঘাঁটিতে আত্মসমর্পনের এই অনন্য ঘটনায় অসামান্য যোদ্ধা হেলাল সহ তাঁর যোদ্ধাদলের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। হেলাল কোম্পানীরই দুই বীর যোদ্ধা বশির আর সঞ্জু বয়ে নিয়ে যান আত্মসমর্পনের সেই ঐতিহাসিক চিঠি। তাঁরই কোম্পানীর যোদ্ধা আমানুল্লা কবীর শহীদ হন কামালপুরের যুদ্ধে। তাঁকে ভূষিত করা হয় বীরবিক্রম খেতাবে।
কামালপুরের বিজয়ের পর ১০-১১ই ডিসেম্বর রাতে মুক্ত হয় জামালপুর। হেলাল কোম্পানী অবস্থান নেয় পি,টি,আই-এ, পাকিস্তানি গ্যারিসনে।
মুক্তিযুদ্ধের পর বিয়ে করেন হেলাল, জামালপুরের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনজীবি তাসির উদ্দিন আহমেদের কন্যা শিক্ষিকা শাহানাকে। তাঁরা এক পুত্র এবং দুই কন্যার জনক-জননী।
বর্তমানে, সত্তরোর্ধ সৈয়দ সাদরুজ্জামান যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠনে। জাতীয় শুটিং ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশনের সাবেক ম্যানেজার রূপে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি বিভিন্ন সময়। মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা সমিতির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। সেই সঙ্গে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন। কর্মসূত্রে, বর্তমানে তিনি জামালপুরের একটি শিল্প উদ্যোগ আর,সি,আই-এর সঙ্গে যুক্ত।
ব্যক্তি জীবনে কিছুটা আত্মপ্রচার বিমুখ এই বীর যোদ্ধা। সম্প্রতি এই অদম্য সাহসী বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ সাদরুজ্জামান হেলাল প্রয়াত হয়েছেন।
একাত্তরে কামালপুর রনাঙ্গণের অসামান্য, দুঃসাহসী এবং দুধর্ষ এই কমান্ডার সৈয়দ সাদরুজ্জামান হেলালকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।