আইনি সুরক্ষা ও আদালতে প্রশ্ন না তোলার অঙ্গীকার চায় কমিশন

জুলাই সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে না এবং সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে— রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এমন দৃঢ় অঙ্গীকার চয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা জুলাই সনদে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সনদের একটি কপি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত সনদটি এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়নি। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার পর সনদ ও সেই প্রক্রিয়া একসঙ্গে পাঠানো হবে।

জুলাই সনদ : বাস্তবায়নের সময়সীমা ছাড়াই দলগুলোকে পূর্ণ খসড়া পাঠাল কমিশনঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদে বলেছে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধারাবাহিক সংগ্রামে বাঙালি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ করে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় একচ্ছত্র ক্ষমতা, সামরিক শাসন, দলীয়করণ, দুর্নীতি ও ভোট ডাকাতির কারণে গণতন্ত্র বারবার বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন জনগণের আন্দোলনকে রুখে দিলেও শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটায়।

সনদের পটভূমিতে ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। যেটা আগের খসড়া সনদে ছিল না। কমিশন আরও বলেছে, টানা ১৬ বছরের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো ঐতিহাসিক জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, সেটিকে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে।

ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখনো সনদের কপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়নি। আগামীকাল ১১ সেপ্টেম্বর সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে কমিশন। এরপর সনদের কপি পাঠানো হবে।

এর আগে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছিলেন, জুলাই সনদ-২০২৫ চূড়ান্ত হয়ে আছে। এখন শুধু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।

গত ১৬ আগস্ট ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো ‍জুলাই সনদের খসড়ায় তিনটি প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বিএনপির আপত্তি ছিল। আপত্তি তোলা প্রস্তাবগুলোতে বলা হয়েছিল, জুলাই সনদের সঙ্গে বিদ্যমান আইন বা সংবিধানের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে জুলাই সনদই প্রাধান্য পাবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সম্পর্কিত সর্বশেষ খবর

আরেক প্রস্তাবে বলা হয়, সনদের যেকোনো ধারা বা সুপারিশের ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা শুধু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের থাকবে। অন্য আরেক প্রস্তাবে সনদের বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ বন্ধ করার কথা বলা হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে এই তিনটি প্রস্তাব চূড়ান্ত সনদ থেকে বাদ দিয়েছে কমিশন। এর পরিবর্তে এখন বিষয়গুলো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হবে না এমন অঙ্গীকার চায় কমিশন। 
এদিকে চূড়ান্ত সনদে কোন দল কোন সংস্কার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে আর কোনটিতে ভিন্নমত জানিয়েছে তা স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে— যা আগের খসড়ায় ছিল না।

বুধবার (১০ আগস্ট) সংসদ ভবনে ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয়, বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া বাস্তবায়নসংক্রান্ত মতামত পুনরায় পর্যালোচনা করা হয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মতামত বিশ্লেষণ করে তা সনদে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার সনদ বাস্তবায়নপদ্ধতি নিয়ে কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের প্রস্তুতির বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

জুলাই সনদে বলা হয়েছে, এটি হলো নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, যা জুলাই–আগস্ট ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নিয়েছে। সেই সময়ে হাজারো মানুষ জীবন দিয়েছে, অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে এবং সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছে। সনদটি জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং একটানা আলোচনার মাধ্যমে অর্জিত ঐকমত্যের ফল হিসেবে তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে হবে।

এতে আরও বলা হয়েছে, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক এবং জনগণের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ আইন। গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাই রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ ২০২৫-কে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে মেনে নিয়েছে। তারা সনদটিকে সংবিধানে সংযুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, শহীদ পরিবারকে সহায়তা এবং আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অঙ্গীকার করা হয়েছে।

উচ্চকক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত জানাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন

রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের রূপরেখাও সনদে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থা সংস্কারে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধন, আইন পরিবর্তন ও নতুন আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, সনদের যে সিদ্ধান্তগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো বিলম্ব না করে দ্রুত বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।