‘আমি খ্রিষ্টান হলেও পুরো রমজান মাসে রোজা রেখেছি’

মিকা স্টিভেনস নামে ১৫ বছর বয়সী এক ডাচ শিক্ষার্থী পবিত্র রমজানের পুরো মাসজুড়েই রোজা রেখেছেন। মিকা মুসলিম নন, বরং একজন খ্রিষ্টান যে কি না নিজ ধর্মের শিক্ষাকেও পবিত্র মনে করেন।

বিবিসি আরবি বিভাগকে তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে আমার বড় ভাই, যার বয়স এখন ১৮ বছর , তিনি গোপনে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং রোজা রাখা শুরু করেন। আমাদের পরিবারের কী প্রতিক্রিয়া হবে এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ আমাদের খ্রিষ্টান পরিবারে গ্রহণযোগ্য ছিল না।’

তিনি আরেও বলেন, ‘কিন্তু বাবা-মা বিষয়টি জানার পরে আমার সাথে আলোচনা করেছিলেন। তারা আমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বিভিন্ন সংস্কৃতির স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমার মা একজন খ্রিষ্টান এবং বাবার কোনও ধর্ম নেই। আমি মাকে পছন্দ করি এবং আমি নিজেও খ্রিষ্টান।’

ষোল বছর বয়সের আগ পর্যন্ত মিকার ভাই খ্রিষ্টান ছিলেন। কিন্তু তার কিছু মুসলিম বন্ধুর সাথে আলোচনা এবং কিছু ইসলামিক বই পড়ার পর তিনি গোপনে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। মিকা বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে এর কারণ হিসেবে মনে হয়েছে সে যা চাইত তা সে ইসলামের মধ্যে পেয়েছে।’

মিকা বিবিসিকে ব্যাখ্যা করেন কীভাবে তিনি ও তার ভাই ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। স্কুলে ও কর্মক্ষেত্রে তার ও তার মুসলিম বন্ধুদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ধর্মের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব নিয়ে কথোপকথন হয়েছিল।

তিনি বলেন, তার তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুই মুসলিম এবং তারা সকলেই রমজানে রোজা রাখেন।

প্রার্থনা করছেন মিকা

স্রষ্টার নৈকট্য লাভের আশা

যখন আমি মিকাকে প্রশ্ন করলাম, একজন খ্রিষ্টান হওয়া সত্ত্বেও কেন আপনি ইসলামিক রীতিতে রোজা রাখেন? মিকা আমাকে বলেন, ‘কারণ আমি স্রষ্টার কাছাকাছি রয়েছি এটা অনুভব করি।’

এটা লক্ষণীয়, গত এক দশকে নেদারল্যান্ড-সহ ইউরোপে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া-সহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এ সংখ্যা বাড়ছে। আরেকটি কারণ হলো ইউরোপে হাজার হাজার শরণার্থীর অনুপ্রবেশ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেদারল্যান্ডে কোনও ধর্মে বিশ্বাস করেন এমন লোকের হার কমেছে।

২০২১ সালে নেদারল্যান্ডসের সামাজিক সংহতি ও সুস্থতার ওপর একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ বছর বয়সী বা তার বেশি বয়সী ডাচ জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশ কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায় বা মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত নয়। বিশেষ করে খ্রিষ্টান ক্যাথলিকদের হারও কমেছে।

যাই হোক, ধর্মীয় সম্প্রদায় হ্রাসের এই সময়ের মধ্যেই ডাচদের একটা অংশ অন্যান্য ধর্মকে অনুসরণ করছে এবং ইসলামের মতো বিভিন্ন ধর্মকে গ্রহণ করছে। বিশেষ করে রমজানের সময় এদের মধ্যে অনেকেই তাদের নতুন মুসলিম শরণার্থী প্রতিবেশীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

মিকা বলেন, ‘প্রথমে আমার ভাই আমাকে ইসলামের মূল নীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে আমার কাছে ব্যাখ্যা করে।’

তিনি বলেন, ‘আমার ভাই লেভি একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে আমি ধর্ম নিয়ে বেশি আলোচনা করি এবং তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমার স্কুলের বন্ধুদের সাথেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। এমন কী আমাদের এই আলোচনায় ধর্ম পালন করেন না এমন অনেক সহকর্মীও যোগ দেয়।’

তিনি আরেও বলেন, ‘আমি আমার ভাইয়ের কাছে থাকা বইগুলো পড়ি এবং এগুলো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করি। বিশেষ করে কিছু অসঙ্গতি বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সম্পর্কে বুঝতে চাই। যেগুলো আমাকে বইগুলো পড়া এবং গবেষণা করে জানতে আরেও আগ্রহী করে তুলেছে। পরিশেষে বলা যায়, সব ধর্মেই একজন স্রষ্টা রয়েছেন।’

তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘আমি রমজানের সময় রোজা রাখা শুরু করেছি, এটা সত্যি। কিন্তু আমি আমার খ্রিষ্টান ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত। রোজা রাখতে যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে সেটি হলো- স্রষ্টার নৈকট্য লাভের আশা। কারণ রোজা রাখার মধ্য দিয়ে, আমি স্রষ্টার প্রতি আমার ভক্তি পরীক্ষা করি।’

তিনি বলেন, ‘জীবনে লোভের মুখে নিজেকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সেই ক্ষমতা যাচাই করি এবং স্রষ্টা ও তার প্রতি অনুভূতির জন্য নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করি। দরিদ্র যারা নিজের ক্ষুধা মেটানোর জন্য কিছুই খুঁজে পায় না তাদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয় এবং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাদের দিয়েছেন।’

মিকা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছে আমার ভাই লেভি। প্রথম বছর গোপনে রোজা রাখতো। কিন্তু এখন আমরা দুইজন এবং আমার বাবা-মা আমাদের পছন্দকে সম্মান করেন। এমন কী আমাদের রোজা রাখার জন্য উপযোগী একটি আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করেন। যেমন সেহেরি এবং ইফতারের নির্দিষ্ট সময়ে খাবার তৈরি করা।’

মিকা বিশ্বাস করেন এখনও তার অনেক কিছু শেখার বাকি রয়েছে। কিন্তু একই সময়ে প্রসন্ন বোধও করেন। কারণ তিনি নিজেকে এমন জিনিস থেকে বঞ্চিত করেন, যা তিনি ভালোবাসেন এবং স্রষ্টার স্বার্থে ক্ষুধা, তৃষ্ণাও সহ্য করেন।

কারণ এটা তার ব্যক্তিত্ব গঠন ও শক্তিশালী করতে এবং জীবনে ভবিষ্যতের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় তৈরি করে।

‘নাস্তিক বাবা ও বিধর্মী মা’

মিকা স্কুলে যেসব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তাদের মধ্যে একজন সিরিয়ান ছেলে গাবি। যার বয়স এখন ১৬ বছর। গাবির তখন পাঁচ বছরও হয়নি যখন তার পরিবার, বাবা-মা এবং বোনকে আলেপ্পো শহর ছেড়ে তুরস্ক যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালে তারা নেদারল্যান্ডস পৌঁছায়।

ফোনে নেওয়া ইন্টারভিউতে গাবি বলেছেন, ‘নয় বছর বয়সে আমি গোপনে রোজা রাখা শুরু করি। আপনার কাছে আমি লুকাব না যে আমার বাবা-মা এটা জানতে পেরে মর্মাহত হয়েছিল যে ঐ সময়ে আমি গোপনে রোজা রাখছি। তারা আমাকে এটা ভেবে বাধা দিতে চেয়েছিল যে আমি ছোট ছেলে, এটা সহ্য করতে পারবো না। কিন্তু আমি পিছুপা হইনি।’

তিনি বলেন, ‘বরং আমি রোজা রাখতে অনড় ছিলাম কারণ আমার বিশ্বাস থেকে এটা আমি শুরু করেছিলাম এবং এখনও আমি করছি।’

গাবির মা নিজেকে অধার্মিক বা ধর্মহীন বলে পরিচয় দেন যেখানে তারা বাবা নিজেকে স্পষ্টতই নাস্তিক বলে বর্ণনা দেন।

মিকা ও তার সিরিয়ান বন্ধু গাবি

নেদারল্যান্ডসের একটি ছোট্ট শহরে বসবাসকারী গাবির সাথে যখন ফোনে কথা বলছিলাম তখন তাকে প্রাপ্তবয়স্ক মনে হচ্ছিল। কারণ তার মতামত প্রকাশে অন্য ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের আঘাত না করে সুনির্দিষ্ট উত্তর ও সতর্ক শব্দ চয়ন।

গাবি মুসলিম ধর্মে তার আগ্রহের শুরু সম্পর্কে আমাকে বলেছেন, যখন তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রাথমিক স্কুলে থিতু হয় তখন তিনি একজন মুসলিম সহপাঠীর সাথে পরিচিত হয় এবং পরে তারা ওই শ্রেণিকক্ষে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়।

গাবি তখন লক্ষ্য করেছিলেন, তার বন্ধু স্কুলে কিছু খেত না ও পানিও পান করত না। পরে বন্ধুর কাছ থেকে রোজা রাখার বিষয়ে জেনেছিলেন তিনি। সে যেমনটি বলেছে সে অনুযায়ী, ‘রোজা একজন ব্যক্তিকে স্রষ্টার কাছাকাছি নেয় এবং তাকে খুশি করে।’

গাবির মা বিবিসিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘একদিন গাবি স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ থেকে স্কুলের খাবার বের করে ও ঘোষণা দেয়, সেও ক্লাসের বন্ধুর মতো রোজা রাখছে।’

তার আকস্মিক এমন সিদ্ধান্তে পরিবার হতভম্ব হয়ে যায়। কারণ সে তাদের সাথে আলোচনা না করেই দ্রুত নিজের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন শুরু করে দেয়। তার পরিবার ভেবেছিল, বিশেষ করে যেহেতু সে এখনও একজন ছোট ছেলে, রোজা রেখে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

কিন্তু গাবি রোজা রাখতে জেদ করেছিল। তাই তার মা তার সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তার সাথে দুপুর পর্যন্ত রোজা রাখতে হবে এবং স্কুলের খাবার খেতে হবে যেটা তার মা তাকে প্রতিদিন তৈরি করে দিত। এতে সে সম্মত হয়েছিল।

গাবি বলেন, ‘আমি বাবা-মাকে বিরক্ত করতে চাইনি। আমি এই চুক্তি মেনে চলছি এমন ভান করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে আমি ওই খাবার আমার স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিকটস্থ বাগানের হাঁসদের খাওয়াতাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু স্কুলের খাবার নিয়ে মিথ্যা বলাটা আমি পছন্দ করছিলাম না। তাই আমার মাকে স্পষ্টভাবে বলেছিলাম খাবার খেতে আমাকে বাধ্য করবেন না’।

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘আমি গভীরভাবে বলেছিলাম যে আমি স্রষ্টার নৈকট্য লাভ ও তাকে খুশি করতে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাহলে আমি যদি মিথ্যা বলি তবে কীভাবে তা সফল হতে পারে?’

আধুনিক শিক্ষা

গাবির মা আমাকে বলেছিলেন, তিনি আধুনিক প্যারেন্টিং পদ্ধতি সম্পর্কে যত্নশীল। তিনি দেখছিলেন যে তার ছেলেকে মিথ্যা বলতে বাধ্য করা হতে পারে এবং তিনি ও তার স্বামী এর কারণ হতে পারেন।

এসব চিন্তা করে গাবির মা বিষয়টি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও তিনি সন্তুষ্ট হননি। কিন্তু তিনি ছেলের নিষ্পাপ মানসিকতা ও স্পষ্টবাদিতা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এবং তাকে মিথ্যা বলার দিকে ঠেলে দেবেন না বলেও স্থির করেছিলেন।

গাবির মা বলেন, একদিন সে স্কুল থেকে ফিরে চরম ক্লান্তি ও তৃষ্ণায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। যখন আমরা তাকে পানি খেতে দেই তখন তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সে আমাদের উপর বিরক্ত হলো কারণ তার সেদিনের রোজা আমরা ভেঙ্গে দিয়েছিলাম।

তার মা নিজের বিস্ময় লুকিয়ে রাখতে পারছিলেন না। নিজের ছেলের ব্যক্তিত্ব, বিরোধী আচরণ এবং চিন্তার স্বাধীনতা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের ছেলেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন।

গাবির মা বলেন, ছেলের অবিচল অবস্থানে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। মনে মনে ভাবতে শুরু করেছিলেন, চারপাশের উপহাস ও সমালোচনার শিকার হওয়া সত্ত্বেও কোন বিষয়টি এই শিশুটিকে সিদ্ধান্তে অটল রাখছে। এছাড়া ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অনুভূতি তো রয়েছেই।

তার মা অনুশোচনায় ভুগছিলেন যে, ছেলে একা এইসব সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছিল। তিনি তার পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরে গাবির মাও তার সাথে রোজা রাখা শুরু করেছিলেন। যাতে গাবি এটা ভাবতে পারে যে, পরিবারে একমাত্র সেই রোজা রাখেনি!

গাবি যাতে রমজান মাসের প্রকৃত পরিবেশ অনুভব করতে পারে সেজন্য বিখ্যাত সব সিরিয়ান খাবার তৈরি করেও টেবিলে দিতে শুরু করেন।

গাবি বলেন, ‘যখন মা আমার সাথে রোজা রাখতে শুরু করেছিলেন, তখন আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আমি আরও শক্তি অনুভব করেছিলাম কারণ যারা আমার রোজা রাখায় আপত্তি করেছিল তাদের মুখোমুখি হতে আমরা তখন একজন থেকে দু’জন মানুষ হয়েছিলাম।’

তখন থেকে প্রতি বছর গাবির মা তার সাথে রোজা রাখেন। এবং তার ১৮ বছর বয়সী বোনও তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন।

মিকা বলেন, তিনি রমজান মাসে রোজা রাখতে থাকবেন। নিজের খ্রিষ্টান ধর্ম বজায় রেখেই জ্ঞানের সন্ধান করতে থাকবেন, যা তিনি চরম নিষ্ঠার সাথে ধারণ করেন। বিবিসি বাংলা