ইরানিদের কাছে আহমাদিনেজাদ কেন এত জনপ্রিয়

সৎ, সাহসী, পরিশ্রমী ও দূরদর্শী নেতা হিসেবে সারা বিশ্বেই ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ সমাদৃত।  তিনি ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুই মেয়াদে ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি যে ধরনের জীবনযাপন করতেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পরও সাধাসিদে জীবন ছিল তার। 

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট পদে আবার নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন আহমাদিনেজাদ। শোনা যাচ্ছে, তিনি আবারও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন। তার প্রার্থিতা ঘিরে দেশটিতে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আসুন জেনে নিই নেজাদের প্রাথমিক জীবন ও প্রাত্যহিক জীবন সম্পর্কে—

আহমাদিনেজাদ ১৯৫৬ সালের ২৮ অক্টোবর তেহরানের পাশে গার্মসার নামে একটি শহরের প্রত্যন্ত গ্রামে ও খুব গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন পেশায় একজন কামার আর মায়ের নাম খানম। মায়ের উপাধি ছিল সাইয়েদা, যা শুধুমাত্র মুহাম্মদ (স)-এর বংশধর হলেই এই উপাধিতে ডাকা হয়।

আহমেদিনেজাদের বয়স যখন চার বছর, তখন তার বাবা জীবিকার সন্ধানে পরিবারসহ তেহরানে চলে আসেন। সেখানেই আহমাদিনেজাদের স্কুলজীবন শুরু। ১৯৭৬ সালে আহমাদিনেজাদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি ৪০০,০০০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৩২তম স্থান দখল করেন। তিনি ইরান ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড টেকনোলোজিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৯৭ সালে তিনি ট্রান্সপর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

আহমাদিনেজাদ ১৯৭০ সালের শেষের দিকে ‘সারকর্ড’ শহরের মেয়রের উপদেষ্টা হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৮০ সালে তিনি আর্মিতে যোগদান করেন। এর পর তিনি তুর্কি বর্ডারের কাছে ‘মাকু’ শহরের মেয়র পদে নিযুক্ত হন। ১৯৯০-এর শেষের দিকে তিনি ‘আরদাবিল’ শহরের গভর্নর পদে নিযুক্ত হন। পরে তিনি হার্ডলাইন রেভুলেশনারি গার্ডের বিশেষ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০৩ সালে আহমাদিনেজাদ তেহরানের মেয়র পদে নির্বাচিত হন। মেয়র থাকাকালে তিনি নিজ হাতে তেহরানের রাস্তা ঝাড়ু দিতেন। 

দুই বছর তেহরানের মেয়র থাকার পর ২০০৫ সালে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আহমাদিনেজাদ ক্ষমতায় আসেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই তিনি তার অফিসে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। প্রেসিডেন্ট ভবনের দরজা-জানালা খুলে দেওয়া হয় সাধারণের জন্য। প্রেসিডেন্ট অফিসে সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সাধারণ ইরানিদের চিঠি গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তার জীবনযাপন যেমন ছিল পরেও ঠিক তেমনটিই ছিল। আভিজাত্য তাকে কখনো ছুঁতে পারেনি। তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তেহরানের বস্তিতে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাড়ি, যা ৪০ বছর আগে তিনি তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। বেতন হিসেবে তিনি তেহরান ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র ২৫০ ইউএস ডলার পেতেন। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান হয়েও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কোনো টাকা নিতেন না। তিনি ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া বেতনের টাকা দিয়েই সংসার চালাতেন। 

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিলাসবহুল এক বাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেই বাড়িকে তুচ্ছজ্ঞান করে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বস্তির সেই দুই রুমের ছোট্ট বাড়িতেই বসবাস করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সরকারের কর্মকর্তাদের অনুরোধে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে বসবাস করতেন। 

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই প্রেসিডেন্ট ভবনের দামি কার্পেটগুলো তেহরানের মসজিদে দান করে দেন। এর পরিবর্তে সাধারণ মানের কার্পেট বিছানো হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। আর সেই প্রেসিডেন্ট ভবনের মেঝেতে সেই সাধারণ মানের কার্পেটের ওপরই ঘুমাতেন তিনি। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ভবনের ভিআইপি অতিথিশালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একটি সাধারণ ঘরেই ভিআইপিদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা রাখা হয়।

৩ আগস্ট ২০১৩ ইরানের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেওয়ার আগেও ইতিহাস তৈরি করে যান আহমাদিনেজাদ। ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান আয়াতুল্লাহ সাদেক লারিজানির কাছে লেখা এক চিঠিতে আট বছরে অর্জিত সম্পদের হিসাব দিয়ে যান তিনি। যে হিসাবে দেখা যায়, ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার সম্পদে যে পরিবর্তন এসেছে, তা হলো— তিনি তার পুরোনো বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেছেন। তবে বাড়িটি পুনর্নির্মাণের জন্য তিনি ব্যাংক ও প্রেসিডেন্ট দপ্তরের ফান্ড থেকে ঋণ নেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তরের ফান্ড ও ব্যাংক থেকে বাড়ি নির্মাণের জন্য অসংখ্য মানুষ ঋণ নিয়ে থাকেন। প্রেসিডেন্টও সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে সেই ঋণ নিয়েছেন। 

ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো ধরনের প্রভাব খাটাননি। একই সঙ্গে বাড়ি পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরাও সহযোগিতা করেছেন। পুনর্নির্মিত দোতলা ভবনে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ওই ভবনেই তিনি ও তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। যে জমিতে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটার আয়তন মাত্র ১৭৫ বর্গমিটার। জমিটুকু বাবার কাছ থেকে পাওয়া।

প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় ছেলের বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছিলেন মাত্র ৪৫ জন (২৫ জন নারী এবং ২০ জন পুরুষ) অতিথিকে । শুধু কমলা, আপেল, কলা ও ছোট এক টুকরো কেক দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এনবিসি নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি অত্যন্ত হাসিমুখে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন— এর চাইতে বেশি মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।

প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষে তিনি তার আসল পেশা শিক্ষকতায় ফিরে যান। পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। পাবলিক বাসে চড়ে ক্লাস নিতে যান নেজাদ। সাবেক প্রেসিডেন্ট হয়ে পাবলিক বাসে চড়তে এতটুকু অস্বস্তি নেই তার।

মূলত সৎ সাধাসিদে জীবনযাপনের জন্য ইরানের সাধারণ মানুষের কাছে এত জনপ্রিয় আহমাদিনেজাদ। সেই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের আতঙ্ক হয়ে আছেন এখনো। 

২০১৭ ও ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গার্ডিয়ান কাউন্সিল নেজাদের প্রার্থিতার অনুমোদন দেয়নি। ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর সাবেক এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতির স্পষ্টবাদী সমালোচক হয়ে ওঠেন। এমনকি প্রকাশ্যে ইরানের শীর্ষ নেতা খামেনিরও তিনি সমালোচনা করেন। তিনি গত দুই বছর ধরে সর্বোচ্চ নেতার ঘনিষ্ঠ অনুগতদের কোপানাল এড়াতে বেশিরভাগ সময় ‘চুপ’ থেকেছেন। খামেনির উত্তরসূরি এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে সাংবিধানিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’ কর্তৃক অনুমোদন পেতে হয়।

এদিকে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর ইরানে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৮ জুন। আর এই নির্বাচনে আহমাদিনেজাদ প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। সংসদে আহমাদিনেজাদ সমর্থকরা ইতোমধ্যেই আহমাদিনেজাদের সম্ভাব্য প্রার্থিতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, আহমাদিনেজাদই ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

ইরানের পার্লামেন্টে তাবরিজ অঞ্চলের প্রতিনিধি আহমাদ আলীরেজা বেইগি বলেছেন, যদি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাহলে তিনি বিজয়ী হবেন। পাশাপাশি তিনি সতর্ক করে বলেছেন, গার্ডিয়ান কাউন্সিলকে অবশ্যই আহমাদিনেজাদের প্রার্থিতার অনুমোদন দিতে হবে। তিনি যদি প্রার্থী হন এবং এই প্রার্থিতাও যদি বাতিল করা হয় তাহলে সেটার পরিণতি খুব খারাপ হবে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও ব্রিটানিকা।