এনবিআর বিলুপ্ত : প্রতিবাদে কাল থেকে কলমবিরতি

পরামর্শক কমিটির সুপারিশ এড়িয়ে ও স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দুই ভাগ করে জারি করা অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়ে এনবিআরের অধীন সব কাস্টম হাউস, শুল্ক স্টেশন, কর অঞ্চল ও ভ্যাট কমিশনারেটে তিনদিনের কলম বিরতির ঘোষণা দিয়েছে সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

মঙ্গলবার (১৩ মে) আগারগাঁও এনবিআরের সামনে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই কলম বিরতির ঘোষণা দেন। দাবি আদায় না হলে ১৭ মে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও অবস্থান কর্মসূচিতে জানানো হয়েছে।

সংগঠনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত কমিশনার (কাস্টমস ও ভ্যাট) সাধন কুমার কুন্ডু বলেন, বর্তমান সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গতকাল অধ্যাদেশটি জারি হয়েছে। এই সংস্কারে সরকার যে কমিটি করেছে, সেখানে দেশের যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সেই কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। প্রত্যাশী সংস্থা হিসেবে আমরাও জানতে পারিনি। ভালো-মন্দ কিছুই জানতে পারিনি। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, আমাদের মতামতকে উপেক্ষা করে গতকাল রাতে অনেকটা গোপনীয়ভাবে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছে, যা অন্যান্য অধ্যাদেশের মতো নয়। আমরা তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা চাই, অধ্যাদেশটি বাতিল করে পরামর্শক কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেই প্রতিবেদনের আলোকে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে দেশের ভালোর জন্য, দেশের রাজস্ব ও মানুষের ভালোর জন্য নতুন অধ্যাদেশ জারি হবে। অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য আমরা তিনদিনের কলম বিরতি দিয়েছি।

তাদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— আগামী ১৪ মে বুধবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা, ১৫ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা ও ১৭ মে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কলম বিরতি পালন করবে। তবে কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা, আমদানি-রপ্তানি ও বাজেট-এই তিনটি কার্যক্রম চালু থাকবে। বাকি সব কার্যক্রম কলম বিরতির আওতায় বন্ধ থাকবে। আগামী ১৭ মে বিকেল তিনটায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে সাধন কুমার কুণ্ডু বলেন, আমরা এই মুহূর্তে সেভাবে পয়েন্ট আউট করছি না। আমরা চাচ্ছি, সরকার যে সংস্কার কমিটি গঠন করেছে, সেই কমিটির প্রতিবেদন জনসম্মুখে আনা হোক। সেখানে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়া হোক। সঙ্গে আমাদেরও মতামত নেওয়া হোক। তার ভিত্তিতে যেটি দেশ ও রাজস্বের জন্য ভালো হবে, সেটাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

অন্যদিকে সংগঠনের পক্ষ থেকে যুগ্ম কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা বলেন, কাস্টমস এবং ট্যাক্স-এই দুইটি ক্যাডার, আমরা সরকারের টেকনিক্যাল জায়গা থেকে কাজ করি। ট্যাক্স এবং কাস্টম্‌সের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের লোকজন আমাদের সঙ্গে সমবেত হয়েছেন। সারাদেশে আমাদের কর, কাস্টমস ও ভ্যাটের অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন। সবার প্রতিনিধিত্ব করে আমরা জমায়েত হয়েছি। এটা আমাদের কারো ব্যক্তিগত বা কোনো ক্যাডার সার্ভিসের বিষয় নয়।

তিনি বলেন, আমরা বিশেষায়িত ক্যাডার হিসেবে এই দুইটি সংস্থার সব সার্ভিসের লোকজন কাজ করি। জাতীয় রাজস্ব আহরণের জন্য আমাদের বিশেষায়িত প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মটি আজ থেকে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে এই দুই ক্যাডার সার্ভিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী সবসময় একমত ছিলো। এবং এই সংস্কার কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানিয়ে সবাই সহযোগিতার হাত ধরে, আমরা আশা করেছিলাম, সবার মতামতের প্রতিফলনে জাতীয় কনসেসারের মধ্য দিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আজ যে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে, তা দেখবো। কিন্তু এই অধ্যাদেশ জারি হওয়ার প্রক্রিয়ায় গত তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ৩ থেকে ৪শ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিনিয়ত জমায়েত হয়েছে যে অধ্যাদেশটি হচ্ছে, সেখানে তাদের কথা বলার জন্য। কিন্তু একটা পর্যায়ে জানতে পারা গেছে যে, সেখানে সর্বময় সার্ভিসের কারো-ই মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। যেটি নিয়ে দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক কাঠামো, যেটি কিনা রাষ্ট্রের ভিত্তি। এবং সেই ভিত্তিটি যেন জনবান্ধব এবং সংস্কারের পজিটিভ ভিউকে মাথায় রেখে হয়। তার জন্য আমরা সবাই একত্রিত হয়েছিলাম। সর্বশেষ গতকাল অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। যে ফরমেটে অধ্যাদেশটি জারি হয়েছে সেখানে কাস্টমস এবং ট্যাক্সের সার্ভিসের কারো চাওয়া বা ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি।

তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারের সংস্কার কর্মসূচির ওপর আস্থা রাখি। সরকার খুবই সুন্দরভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সংস্কার কার্যক্রমের প্রক্রিয়া হিসেবে সংস্কার কমিশন করেছে। তেমনিভাবে রাজস্ব বোর্ড সংস্কারের জন্য একটি পরামর্শক কমিটিও করা হয়েছিল। তারা অন্যান্য কমিশনের মতো প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আমরা সবাই পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন দেখতে পাইনি। কারণ এটি প্রকাশ করা হয়নি। রাজস্ব সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যারা ছিলেন, তাদের মতামতের প্রতিফলনও এই অধ্যাদেশে হয়নি বলে জানতে পেরেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে সুস্মিতা বলেন, এখানে কোনো ক্যাডারের বিরুদ্ধে বা বিপক্ষে প্রশ্নে আমাদের অবস্থান নয়। কারণ আমরা সবাই রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হিসেবে কাজ করি। আমাদের যে অধ্যাদেশটি হয়েছে, সেই অধ্যাদেশের ফরমেট অনুযায়ী ট্যাক্স এবং কাস্টমস ক্যাডারকে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পলিসি কন্টিভিউশনে কন্ট্রিবিউট করার মতো অবস্থা নেই। সেখানে আমাদের কোনো ফাংশনাল অবস্থান আপাত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি না। এই জায়গাতে আমাদের অবস্থানগত জায়গা। আমরা টেকনিক্যাল ক্যাডার হিসেবে যে আমাদের বিশেষায়িত জ্ঞান, ৩০ বছর ধরে অর্থনীতির গতি বিধির জায়গাতে, সেটিকে রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের এই জায়গাগুলোতে অবস্থান থাকা দরকার ছিলো। এখনো পর্যন্ত এটি বিধি, কারণ অর্গানোগ্রাম এখনো হয়নি। হলে পরে সেখানে নিশ্চয় আর কোনো সুযোগ নেই যে এই অবস্থানটি কীভাবে থাকবে। এই জায়গাতে আমাদের কোনো ক্যাডারের সঙ্গে দ্বিমতের জায়গা না। আমরা শুধু বিশেষায়িত ক্যাডার হিসেবে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউট করার যথাযোগ্য জায়গাটি চেয়েছি, এবং তার জন্য সরকারের সঙ্গে আমাদের মতামতের প্রতিফলনটি যৌথভাবে যেন হয় সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে।

সংগঠনের পক্ষ থেকে উপকর কমিশনার শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহী বলেন, আমাদের ক্ষোভের জায়গা হলো সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে। একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হলো। আমরা দেখলাম, অন্যান্য সংস্কারের ক্ষেত্রে কমিটি একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের ওপর সব স্টেকহোল্ডাররা আলাপ, আলোচনা করছেন। স্টেকহোল্ডারদের কোনো মতামত থাকলে সরকার সেটা শুনছেন, অ্যাকুমোডেট করে সরকার হয়ত বাস্তবায়নের দিকে যাবেন। রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড এনবিআর। সেটা বিলুপ্ত করার আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা অতীব জরুরি বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি, এই অধ্যাদেশ ফেরত এনে বাতিল করে প্রয়োজনীয় সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সবার মতামতের ভিত্তিতে নিরীক্ষার মাধ্যমে এই সংস্কার কার্যক্রমটি সম্পন্ন করা হোক।

তোপের মুখে এনবিআর চেয়ারম্যান :

বিকেল সোয়া চারটার দিকে এনবিআর ভবন প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। তখন কর্মকর্তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলেন। তারা  এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেখে ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দেন কয়েকজন। পরে কালো জিপ গাড়িতে করে এনবিআর ছাড়েন চেয়ারম্যান।

নতুন এই অধ্যাদেশ জারির ফলে দীর্ঘদিনের রাজস্ব সংস্থা এনবিআরের অস্তিত্ব এখন আর থাকলো না। রাজস্ব খাত এখন থেকে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’— এই দুই ভাগে পরিচালিত হবে। এনবিআরের আওতায় থাকা কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা এতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

অধ্যাদেশের খসড়া পর্যায় থেকেই কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সরকার তাদের মতামত উপেক্ষা করেই প্রায় অপরিবর্তিত খসড়ার ভিত্তিতে চূড়ান্ত অধ্যাদেশ জারি করেছে। কেবল রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে।