এম্পাওয়ারিং সেফটি ফর গালর্স’ প্রকল্প নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জামালপুরের ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ : শিরোপামূল্যে চলছে কারাতে প্রশিক্ষণ

নিজস্ব সংবাদদাতা : একটি বৈশি^ক প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জামালপুরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই মেয়ে শিক্ষার্থী। তিন মাসের কোর্স শেষে আত্মরক্ষা ও ক্ষমতায়ণ নিয়ে ‘এম্পাওয়ারিং সেফটি ফর গার্লস’ প্রকল্পটি শিক্ষার্থীরা নিজেরা তৈরি করে জমা দেয়। পরে সারা বিশে^র কয়েক হাজার প্রকল্প থেকে এই প্রকল্পটি বিশ^ চ্যাম্পিয়ন হয়। বিজয়ী হওয়ায় তারা যে শিরোপামূল্য বা অর্থ পেয়েছে তা দিয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা শিখছে কারাতে।
জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে অবস্থিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের পরিবেশ বেশ মনোরম। সুপরিসর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগীতা ও পাঠ বহির্ভূত কার্যক্রমে অংশ নিয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের মত ‘দ্যা ইকোনোমিস্ট এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন’ গত বছর বিশ^ব্যাপী ‘লিডারশীপ ফর চেঞ্জ প্রাইজ ২০২৪’ নামে একটি প্রতিযোগীতার আয়োজন করে। এই প্রতিযোগীতায় বিশে^র ৬টি মহাদেশের ২৩টি দেশের ৩৫৬টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে অংশগ্রহণ করে। তেমনই একটি প্রকল্প ‘এম্পাওয়ারিং সেফটি ফর গার্লস’ নিয়ে অংশগ্রহণ করে ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ৯ম শ্রেণীর দুই শিক্ষার্থী জিম ও সাবাবা। প্রকল্প তৈরি ও তা প্রদান করতে শিক্ষার্থীদের সার্বিকভাবে তদারকি করেন একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইংরেজী বিভাগের প্রভাষক সাফিয়া আনসারি। প্রতিযোগীতার আয়োজক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ৬টি ৯০ মিনিটের আন্তর্জাতিক মানের কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব এবং সমাজে ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পরিকল্পনা করেছিল। কোর্স শেষে দুই শিক্ষার্থী জিম ও সাবাবা তাদের শিক্ষক সাফিয়া আনসারির সহায়তায় ‘এম্পাওয়ারিং সেফটি ফর গার্লস’ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করে। প্রকল্পটির শুরু ছিল সহজ, কিন্তু শক্তিশালী উদ্দেশ্যে মেয়েদের আত্মরক্ষা শেখানো। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করা এবং নিজের কথা সাহসের সঙ্গে বলার শিক্ষা দেওয়া। শ্রেণিকক্ষ ওয়ার্কশপ, সচেতনতা কার্যক্রম ও গল্পবলা, কারাতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিখেছে কিভাবে আত্মবিশ^াসী হয়ে জীবনের বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। প্রায় সাড়ে ৭ হাজার প্রকল্প থেকে প্রাথমিকভাবে সংক্ষিপ্ত তালিকায় জামালপুরের ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের নাম উঠে আসে। পরবর্তীতে সারা বিশ^ থেকে অংশ নেয়া সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে চ্যাম্পিয়ন হয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুই মেয়ে শিক্ষার্থীর দল। ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই দলটি নির্বাচিত হয়েছিল তাদের সৃজনশীল ও মানবিক উদ্যোগের জন্য। যেখানে শিক্ষা ও ক্ষমতায়ণ একসাথে যুক্ত হয়েছে। এটি অনুপ্রেরণাদায়ক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যা মেয়েদের আত্মবিশ^াস ও নেতৃত্ব জাগিয়ে তুলেছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের দল ডিসেম্বরে প্রকল্প জমা দেয়। চলতি বছরের জানুয়ারীতে আনুষ্ঠানিকভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিষয়টি ‘এম্পাওয়ারিং সেফটি ফর গার্লস’ প্রকল্প দলকে অবহিত করে আয়োজক কর্তৃপক্ষ। এই প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দলটি একটি ট্রফি, সার্টিফিকেট ও বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা শিরোপামূল্য অর্জন করে। পরবর্তীতে এই অর্থ দিয়ে ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা কারাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে একদিন করে কারাতে প্রশিক্ষণ করছে, যা এখনো চলমান রয়েছে।
চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য শিক্ষার্থী জিম বলেন, প্রথমে আমি খুব লাজুক ছিলাম, নিজের ওপর বিশ^াস ছিলনা। কিন্তু এই প্রকল্প আমাকে শিখিয়েছে, আমার কণ্ঠেরও মূল্য আছে। আমি নিজেকে এবং অন্যদের রক্ষা করতে পারি। এই প্রকল্প আমাকে বুঝিয়েছে সাহস মানে ঝগড়া করা নয়, সাহস মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় থাকা। কারাতে মানেই শুধুই মারামারি নয়, মনোযোগ নিবদ্ধ করা ও শৃঙ্খলা শেখা।
প্রকল্পটির সমন্বয়কারী ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক সাফিয়া আনসারি বলেন, ‘এম্পাওয়ারিং সেফটি ফর গার্লস’ প্রকল্পটি কেবল আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নয়। এটি আত্মবিশ^াস, সচেতনতা ও নেতৃত্ব গঠনের একটি যাত্রা। আমার সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয় হলো, মেয়েরা এই প্রকল্পটিকে এক সত্যিকারের সচেতনতার আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। শুরুতে ১৫ জন, এরপর ৩০, ধীরে ধীরে ৭২ জন মেয়ে ও ৩৫ জন ছেলে পৃথকভাবে এই কারাতের প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। আমরা ২০০ জনের মতো শিক্ষার্থীকে কারাতে বা আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কর্মশালা করিয়েছি এবং নিজেদের কারাতে ক্লাব শুরু করেছি। আমরা সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। ‘এম্পাওয়ারিং সেফটি ফর গার্লস’ শুধুমাত্র একটি প্রকল্প নয় এটি একটি আন্দোলন। যা বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল ও সমাজে ছড়িয়ে বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে- ‘প্রতিটি মেয়ে নিরাপদ, আত্মবিশ্বাসী ও অপ্রতিরোধ্য হতে পারে’।
এই প্রকল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে ও জমকালো সমাপ্তি অনুষ্ঠান করতে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাজ্যের সনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘দ্যা টেকওয়ে সাইট’ নামে একটি কোম্পানি। তবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কারাতে প্রশিক্ষণ চলমান রাখার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।