দক্ষিণ এশিয়ার কৃত্রিম বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে যাওয়ায় উপজেলাগুলোর সঙ্গে নৌপথে লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার দশ উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলায় নৌ চলাচল থাকলেও পাঁচ উপজেলায় সহজ চলাচলের মাধ্যম হলো নৌপথ। লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উপজেলাগুলোতে যাত্রী পরিবহনসহ পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না।
কাপ্তাই হ্রদের রুলকার্ভ অনুসারে পানি বর্তমানে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। সাধারণত অক্টোবর মাসের পর তেমন কোনো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হ্রদের রিজার্ভ (সংরক্ষিত) পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ছাড়তে হয়। আবার জলেভাসা জমিতে চাষাবাদের জন্য হ্রদে প্রচুর পানি ধরে রাখাও সম্ভব হয় না। সব মিলিয়ে চৈত্রের পর থেকেই পানি কমে যাওয়া ও হ্রদে প্রচুর পলির কারণে নাব্যতা সঙ্কটে রাঙামাটির সঙ্গে উপজেলাগুলোর নৌপথে যোগাযোগে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
জানা যায়, এদিকে পানি ও নাব্যতা সঙ্কটে পণ্য পরিবহনসহ যাত্রীদের প্রচুর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অতিরিক্ত পলির কারণে সামান্য পানি কমে গেলেই দুর্গম অঞ্চলে চলাচলে সমস্যা দেখা দেয়। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে লঞ্চ চলাচল। ছোট ছোট বোটে পথ পাড়ি দিতে গিয়েও দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। নাব্যতা সঙ্কটে বোট আটকে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। এতে খরচ ও সময় দুই বেড়েছে।
ময়মনসিংহ থেকে আসা যাত্রী আবদুল সোবাহান বলেন, আমি ছোট হরিণায় চাকরি করি। চাকরির কারণে আমাকে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু গ্রীষ্মকাল এলে আমাদের কষ্টের সীমা থাকে না। হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়াতে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ছোট বোটে করে যাতায়াত করতে হয়, তাও কয়েকটি বোট পাল্টে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। এতে আমাদের দ্বিগুণ টাকা ব্যয় হয়।
অসুস্থ রোগী নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন জুরাছড়ি উপজেলার বাসিন্দা সুশোভন দেওয়ান। তিনিও জানালেন তার দুর্ভোগের কথা। তিনি বলেন, আমি আমার ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আসা-যাওয়ার ভোগান্তিতে আমার ছেলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। লেকে পানি নেই, লঞ্চ চলে না, সময়ও বেশি লাগে, কষ্টও বেশি হয়।
বোটচালক ওয়াহাব মিয়া বলেন, হ্রদে পানি না থাকায় রাঙামাটিতে এখন পর্যটক খুবই কম আসছে। যারা আসছে তাদের নিয়ে হ্রদে ঘুরতে বের হলেও আমাদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পানি কমে যাওয়াতে অনেক ডুবোচর জেগে উঠেছে। এতে বোট এখানে সেখানে আটকে যাচ্ছে। আগে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে যেতে আমাদের যদি জ্বালানি তেল ৫ লিটার লাগতো, এখন সেখানে লাগছে ১০ লিটার। এতে আমাদের ব্যয়ও বেড়েছে কিন্তু আয় বাড়েনি।
এদিকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় কয়েকশ শ্রমিক পরিবার বেকার হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছে শ্রমিক নেতারা। রাঙামাটি লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দে বলেন, বর্তমানে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকার ফলে আমাদের ইউনিয়নের প্রায় দুইশ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। কারণ আগে লঞ্চের পণ্য পরিবহনের জন্য শ্রমিক লাগতো, এখন লঞ্চও নাই শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আমরা কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিংয়ের দাবি জানাচ্ছি।
এই সঙ্কট সমাধানে কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিংয়ের দাবি জানিয়ে নৌযান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) রাঙামাটি জোনের সভাপতি মঈনউদ্দীন সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গিয়ে এই দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। তিন মাসেরও অধিক সময় হ্রদে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। এর ফলে একদিকে যেমন মালিক-শ্রমিকদের ক্ষতি অন্যদিকে যাত্রীরাও কষ্ট পান। তাই আমরা দীর্ঘ সময় ধরে কাপ্তাই হ্রদ খননের দাবি জানিয়ে আসছি। হ্রদের কিছু নির্দিষ্ট অংশ ড্রেজিং করলে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক হবে, তখন নৌ চলাচলও স্বাভাবিকভাবে করতে পারবে।
সমস্যা সমাধানে হ্রদে ড্রেজিংয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি প্রেরণের কথা জানিয়ে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানান, কাপ্তাই হ্রদ খননের জন্য ৯৭৭ কোটি টাকার একটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে যাচাই বাছাই পর্যায়ে আছে। আশা করছি অতি দ্রুত কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
প্রায় ৬০ বছর আগে বাঁধ নির্মাণের ফলে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর প্রতিবছরই এই হ্রদের পলি জমে ভরাট হচ্ছে হ্রদের তলদেশ। সম্প্রতি পানি কমে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পাঁচ উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ।