গ্রামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ফলে গ্রামে ব্যাংকের শাখাগুলোর মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে ঋণ বিতরণ। ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রধান এ দুটো উপকরণ কমায় গ্রামে আমানতের স্থিতি যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে ঋণের স্থিতিও। একই সঙ্গে গ্রামে ব্যাংকগুলোর শাখাও কমেছে। এর বিপরীতে এজেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটছে গ্রামে। এতে ব্যাংকের কার্যক্রমে ভাগ বসাচ্ছে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। এছাড়া শহরের আওতা বাড়ছে, তেমনি গ্রামের আওতা কমছে। এতেও গ্রামে আমানত ও ঋণ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, পণ্যমূল্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় ও অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমায় সংসারের খরচ মিটিয়ে বাড়তি অর্থ থাকছে না ভোক্তার হাতে। চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকে আমানত রাখলেও তা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, মানের দিক থেকে সঞ্চয় বাড়ছে না। একই সঙ্গে শহরের আওতা বাড়ছে, কিন্তু গ্রামের আওতা কমছে। যে কারণে গ্রামে ঋণ ও আমানত দুটোই কমেছে।
তবে সেপ্টেম্বরে এত বেশি কেন কমেছে এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, তথ্যগত কোনো জটিলতায় এমনটি হয়ে থাকতে পারে। কারণ এক প্রান্তিকে এত বেশি হারে আমানত ও ঋণ কমার কথা নয়।
তবে ব্যাংকারদের মতে, অর্থনৈতিক মন্দায় গ্রামে ঋণের চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে। শুধু কৃষি ঋণই দেওয়া হচ্ছে। তাও গ্রাহকদের অনেকেই নিতে চান না। এছাড়া ছোট ও কুটির শিল্পে গ্রামে আগে ঋণের প্রবাহ বাড়লেও এখন কমছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমায় ঋণ প্রবাহ কমেছে। ফলে গ্রামের মানুষের আয় কমেছে। এতে আমানতও কমেছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গ্রামে আমানতের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে তা বেড়ে ৪ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৯ কোটি টাকায়। এরপর সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায়। জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমানত কমেছে ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে ডিসেম্বরে তা সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকায়। যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। তবে গত এক বছরের হিসাবে গ্রামে ব্যাংকের শাখাগুলোতে আমানতের স্থিতি কমেছে ৭১ হাজার কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ০৭ শতাংশ।
ব্যাংকের মোট আমানতের মধ্যে ২১ শতাংশের বেশি জোগান দেয় গ্রামের গ্রাহকরা। বাকি ৭৮ শতাংশের বেশি আমানতের জোগান দেয় শহরের গ্রাহকরা। অর্থাৎ গ্রামের চেয়ে শহরের গ্রাহকরা প্রায় পৌনে ৪ গুণ বেশি আমানতের জোগান দিয়ে থাকে। যে কারণে গ্রামে আমানত কমলেও মোট আমানতে তেমন প্রভাব পড়ে না। কারণ আলোচ্য সময়ে শহরের আমানত বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে আমানত সামান্য বেড়েছে। এছাড়া শহরের তুলনায় গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কম। বেশিরভাগ বিত্তশালী বা সম্পদশালী বসবাস করেন শহরেই। এ কারণেও গ্রামে আমানতের প্রবাহ কম।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গ্রামে ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে তা বেড়ে হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। জুনে তা আরও বেড়ে ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বরে তা হঠাৎ করে কমে যায়। ওই মাসের শেষে ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়। জুনের তুলনায় কমেছিল ৩১ দশমিক ০৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা সামান্যে বেড়ে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। গত এক বছরের ব্যবধানে গ্রামে ঋণ কমেছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা বা ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মোট ঋণের সিংহভাগই শহরে দেওয়া হয়েছে। গ্রামে ঋণের অংশ একেবারেই কম।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিক থেকে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের আগ পর্যন্ত গ্রামে ঋণ ও আমানত প্রবাহ কিছুটা বাড়ছিল। কিন্তু জুলাই-সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই গ্রামে ঋণ ও আমানত দুটোই কমে যায়। এর মধ্যে আমানত কমে ২৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং ঋণ কমে ৩১ দশমিক ০৪ শতাংশ। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক থেকে দুই খাতেই প্রবাহ সামান্য বেড়েছে। তবে সেপ্টেম্বরে যেভাবে কমেছে সে তুলনায় এখনো বাড়েনি। যে কারণে বছরের হিসাবেও গ্রামে আমানত ও ঋণের প্রবাহ কমেছে।
জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি আমানত কমেছিল ঢাকা বিভাগের গ্রামগুলোতে, দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের গ্রামগুলো। ওই সময়ে ঢাকা বিভাগের গ্রামে আমানত কমেছিল ৪৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে কমেছিল ১৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। রাজশাহীতে সাড়ে ৮ শতাংশ, খুলনায় বিভাগে ১ শতাংশ কমেছিল, বরিশালে ৯ শতাংশ, সিলেটে সাড়ে ১১ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ২ শতাংশ কমেছিল। রংপুর বিভাগে আমানত সামান্য বেড়েছিল।
ঋণের মধ্যে ঢাকা বিভাগের গ্রামগুলোতে সবচেয়ে বেশি কমেছিল, দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চট্টগ্রাম। ঢাকা বিভাগের গ্রামগুলোতে আমানত কমেছিল ৫৫ দশমিক ২০ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে কমেছিল ২০ দশমিক ৬৮ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ কমেছিল। সিলেট বিভাগে বেড়েছিল আড়াই শতাংশ, রংপুরে সোয়া ১ শতাংশ ও ময়মনসিংহে সামান্য বেড়েছিল।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর পল্লী শাখা ছিল ৫ হাজার ৪১৩টি। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২২৪টি। আগে মোট শাখার মধ্যে গ্রামে ছিল ৪৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে গ্রামে শাখা কমেছে ১৮৯টি বা ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু সার্বিকভাবে ব্যাংকের শাখা কমেনি, বরং বেড়েছে।
সূত্র জানায়, বিভাগীয়, জেলা শহর, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো শহর হিসাবে ধরা হয়। এর বাইরে সবই গ্রাম। বর্তমানে পৌরসভার সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের আওতা বাড়ছে। এতে গ্রামের আওতা কমছে। ফলে গ্রামের শাখাও কমছে।