*৩ মার্চ ১৯৭১* অনলাইন সংস্করণ – ১২ ( ৬২ থেকে ৬৪ পৃষ্ঠা)
৩ মার্চ ১৯৭১, আমি ওইদিন সকালে ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে দেখি, বিক্ষিপ্তভাবে শত শত জুতা, সেন্ডেল আর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ । এ দৃশ্য দেখে আমি আর দেরি না করে মেসে ফিরে আসি। গত রাতে ঢাকায় গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের চিৎকার শুনেছি। সমস্ত ঢাকা শহর যেন মৃতের শহরে পরিণত হয়েছে। এদিকে কিছু দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা ঢাকা শহরে লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। বিকেল থেকে শহরে সেনাবাহিনীর টহল শুরু হলো। রাজপথে আচমকা সামরিক কনভয়ের উপস্থিতি জনমনে ভীতির সঞ্চার করে। সামরিক উর্দিপরা পাকিস্তানী সৈন্যদের দানবীয় চেহারা এমনিতেই বাংলার মানুষের মনে ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল।
*ঐতিহাসিক ৭ মার্চ*
বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রবিবার ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহারাওয়ার্দি উদ্যান) মহাসমাবেশের ডাক দেন। তখন সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। যা শুরু হয়েছিল ৩ মার্চ থেকে- ঢাকা শহরসহ সমস্ত বাংলাদেশের জেলা, মহকুমা এবং থানাতে। সমাবেশকে ঘিরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। ৭ মার্চ সারাদেশ থেকে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতাসহ হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহরে আসে। জনসভা সফল করার জন্য ঢাকার জগন্নাথ কলেজসহ অন্যান্য কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায়। আমরা (জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা) সব সময় যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোভাগে থাকতাম।
তখনকার বিশিষ্ট ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ, আ.স.ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহাজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নির্দেশনায় সারা দেশের সমস্ত শিক্ষার্থীরা ছাত্রদের ১১ দফা এবং আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি আদায়ে বাংলার মুক্তি আন্দোলন তথা অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্ররা জান-প্রাণ দিয়ে তা প্রতিপালনের চেষ্টা করে। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিন অর্থাৎ ৭ মার্চ রবিবার, ১৯৭১ সালে হানিফসহ আমরা মেসে অবস্থানরত ২৫/৩০ জন ছাত্র এবং লক্ষ্মীবাজারের শতাধিক সাধারণ মানুষ গজারির লাঠি হাতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সকাল ১১টার দিকে রেসকোর্সে সমবেত হই। আমরা বিশাল সভামঞ্চের সামনে মাটিতে আসন নিলাম।
আগের রেসকোর্স বা বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিসর নগর উদ্যান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মাঠটিকে কখনো কখনো ঢাকা রেসকোর্স নামে ডাকা হতো এবং প্রতি রবিবার বৈধ ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো।
এই রেসকোর্সে ৭ মার্চ, আমরা সকাল সকাল উপস্থিত হয়ে শেখ মুজিবের অপেক্ষায় থাকলাম। মুহুর্মুহু স্লোগানে সমস্ত রেসকোর্স ময়দান প্রকম্পিত হতে শুরু করলো। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, বাংলার শার্দুল শেখ মুজিব মঞ্চে উঠেই সরাসরি ‘কল রেডি’র মাইক্রোফোনের (কলরেডি একটি মাইক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ছিল। মূলত এই প্রতিষ্ঠানটি তখন ঢাকার রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে ভাড়ায় মাইক সরবরাহ করতো) সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ শুরু করলেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’ তাঁর সেই জগৎবিখ্যাত উক্তি দিয়ে ভাষণ শেষ করে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিল রেসকোর্স ময়দানে। প্রতিটি মানুষের হাতেই গজারির লাঠি। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ওই গজারির লাঠি আমরা হাত থেকে কখনো ফেলে দেইনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণটি ছিল এক ঐতিহাসিক ভাষণ, যাকে ইতিহাসবিদরা বাংলার ম্যাগনাকার্টা বা বাংলার মুক্তি সনদ বলে উল্লেখ করেছেন। বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে তাঁর ভাষণ শুরু করেন এবং শেষ করেন ৩টা ৩ মিনিটে। অর্থাৎ ভাষণটি ১৮/১৯ মিনিট স্থায়ী হয়। ভাষণে ৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো ছিল: ১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। ২. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ৩. এই গণহত্যার তদন্ত করতে হবে। ৪. নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
১৯৭১ সালের ৩, ৭ এবং ২৫ মার্চ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির সেই উত্তাল দিনগুলোর কোনো দিন ভুলবো না। দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভাবছিলাম, হয়তো আর দেখা হবে না। ওই যে মিরপুর চিড়িয়াখানায় প্রথম দেখা হয়েছিল আমাদের। তারপর শুধুই চিঠি আদান-প্রদান ছাড়া আমরা সহসা মিলিত হতে পারিনি। তবে আমার মধ্যে কেমন যেন এক ধরনের বিষন্নতা ভর করে বসে। আমি ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য চিঠি লিখি। উত্তরে সে জানায়, খুব শিগগিরই তার বাবা ঢাকা আসবেন তাকে টাঙ্গাইল নিবেন বলে।
দেশের এই অস্থির পরিস্থিতিতে মেয়েদের হোস্টেলে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। আমি ওর চিঠি পাওয়া মাত্র ইসলামপুরে গিয়ে ১৯৪ টাকায় ৬ আনা ওজনের একটি সোনার আংটি কিনে আনি। দেখা করার দিন তারিখ ও সময় জানিয়ে তাকে চিঠি লিখি। নির্ধারিত দিনে আমার ছবিসহ তাকে লেখা চিঠি এবং আংটি নিয়ে ইডেন কলেজ হোস্টেলের গেটে উপস্থিত হই। হোস্টেল গেটে লোহার ফটক তখন তালা মারা। গেটের সামনে বেশ জটলা। ছাত্রীদের খোঁজখবর করতে বা নেয়ার জন্য এসেছেন অনেক অভিভাবক। আমি জটলা ঠেলে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, অনেক মেয়ের মাঝে সেও দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় তাকে ডাকলাম। সে আমাকে দেখেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে গেটের কাছে আসতেই হাত বাড়িয়ে আংটি এবং আমার ছবিসহ একটি চিঠি তার হাতে দিলাম।
চিঠি দিয়েই এদিক ওদিক তাকালাম, কেউ আমাকে দেখে ফেললো নাকি? ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে সবসময় আমার ভিতর এই ভয়টা কাজ করতো। মনে হচ্ছিল, গেট থেকে সরতে পারলেই যেন বাঁচি। পরে জেনেছিলাম, ওই দিনই তার বাবা তাকে টাঙ্গাইলে নিয়ে যান। ভাবছিলাম, সে তো নিরাপদেই বাড়ি গেল, এখন আমি কীভাবে যাবো?
আমার সঙ্গে নওগাঁর পাঁচ/ছয় জন ছেলে ছিল। একসঙ্গে যাবো নাকি পরে একাই যাবো- এ কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারণ, আমার পরলোকগত বাবার একটি পুরনো গ্রুপছবি বড় করে বাঁধাই করার জন্য ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম এবং লক্ষীবাজারের একটি স্টুডিওতে দিয়েছিলাম। কিন্তু স্টুডিওর মালিক সময় মতো ছবিটি ডেলিভারী দিতে পারেনি। একদিন আমি বাবার ছবিটি আনতে ওই স্টুডিওতে গেলাম। কিন্তু স্টুডিও বন্ধ, মালিক সম্ভবত প্রাণ ভয়ে স্টুডিও বন্ধ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
কয়েক দিনের মধ্যেই মেসের বন্ধুদের অনেকেই যে যার মতো দেশের বাড়ি চলে গেল। আমি মেসেই রয়ে গেলাম। সে সময় আমি মিছিল মিটিং নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম বেশি। মেসে তখন আমরা ৯ জন ছিলাম। সারাক্ষণ দেশের পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলতো। মেয়েটার কথা মাঝে মাঝে মনে হতো। সম্ভবত ২৫ মার্চের কালো রাতের আগেই টাঙ্গাইল থেকে ওর একটা অতি দীর্ঘ চিঠি পাই। আংটির জন্য ধন্যবাদসহ আমার ছবি এবং ব্যক্তিত্বের প্রশংসায় ভরপুর ছিল চিঠিটি। খুব দরদ দিয়ে লেখা চিঠি পড়ে ওর প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল।
চলমান …………………..
(গল্পটি ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করুন)
See insights and ads