*শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয়* অনলাইন সংস্করণ – ০৮ ( ৪৪ থেকে ৪৮ পৃষ্ঠা)
আমাদের কলেজ ছাত্রলীগের ভিপি জিন্নাহ ভাই একদিন আমাকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওই দিন শেখ মুজিবুরের সঙ্গে সরাসরি দু’একটা কথা বলবার সুযোগ হয়েছিল আমার। জিন্নাহকে বললেন- ‘এরা তোর কলেজের বন্ধু’ আমি আগ বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম- “স্যার, আমার দেশের বাড়ি রাজশাহী জেলা, নওগাঁ মহকুমা। আমার নাম- আব্দুর রউফ মান্নান।’ তিনি বললেন- ‘দেশের জনগণ এক হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। তোমরা একযোগে কাজ করে যাও।’ ব্যস্ততার জন্য তিনি আর সময় দিতে পারলেন না। এর পূর্বেও একবার পত্নীতলা জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর বারান্দায় তৎকালীন পত্নীতলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজি আব্দুল মজিদ, আমাকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং এই মহান নেতার সঙ্গে করমর্দন করার সুযোগ হয়েছিল আমার।
ষাটের দশকে ঢাকার পরিবেশ ছিল খুব চমৎকার। বায়ু বা শব্দদূষণ এবং নোংরা-আবর্জনার পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ ছিল না। সে সময় ঢাকার এক গ্লাস পানি যেন একটা কচি ডাবের পানি, পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ। ঢাকা ওয়াসা ছিল অত্যন্ত তৎপর, পানির লাইনে কোনো লিকেজ বা ছিদ্র তেমন দৃষ্টিগোচর হয়নি। ওয়াসার কর্মচারি, কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী অথবা ভারত প্রত্যাগত বিহারী মুসলমান শরণার্থী ।
ঢাকার বাজারে পাওয়া যেত তাজা মাছ, বিষমুক্ত শাক-সবজি। কীটনাশক বা রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল ফলানো বা অন্য কোনো রাসায়নিকের অপব্যবহার এখনকার মত ছিল না।
যখন জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই, তখন ঢাকার বাজারে ইলিশ ছিল সবচেয়ে সম্ভা, সারা বছর পাওয়া যেত। দুই সের বা আড়াই সের (এটা আমাদের দেশের পুরনো ওজন পদ্ধতি, যেমন: মণ, সের, ছটাক) ওজনের একটা ইলিশের দাম মাত্র এক থেকে দেড় টাকা । তবে সেসব দিনে সের কেজি দরে মাছ বেচাকেনা হতো না। খাসির মাংস দুই টাকা সের। আমি যেহেতু গ্রামের ছেলে, বাজার-ঘাট দাদার মাধ্যমেই শিখেছিলাম। ছোটবেলা থেকেই দাদা আমাকে হাটে-বাজারে বা গঞ্জে নিয়ে যেতেন। দাদা বাজার করতেন, আমি তখন বাজারের ব্যাগ নিয়ে পিছু হাঁটতাম।
ঢাকায় আসার পর আমার দিন দিন স্বাস্থ্য ভালো হতে লাগলো, শরীরের রং ধবধবে ফর্সা। মাঝে মাঝে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেকেই চিনতে পারতাম না। মেসের বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতো, তুমি চিত্র জগতে চলে যাও, নায়ক হতে পারবে। আমার নেশা ছিল সিনেমা দেখা। বিশেষ করে পাকিস্তানী উর্দু সিনেমা। একটা সিনেমা কম হলেও দশবার দেখতাম। কারণ, বিকেলের কোনো কাজ থাকতো না। প্রতিদিনই ম্যাটিনি শো দেখতাম। কখনো শাবিস্তান, কখনো গুলিস্থান, কখনো মুন, কখনো বলাকা, কখনো বা মধুমিতা সিনেমা হলে। লেখাপড়া এক রকম গোল্লায় পেল। তখন শাসন করার এত পরিবারের কোনো লোক আমার ধারে কাছে ছিল না।
দাদা চিঠি লিখতেন, উপদেশ দিতেন- ‘তোমাকে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে হবে। তোমাকে আমি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দেখতে চাই।’ যতদিন পড়ালেখা করেছি দাদা তাঁর প্রতিটা চিঠিতে এক কথাই বারবার উচ্চারণ করেছেন, ‘আমি তোমাকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দেখতে চাই।’
যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ি, তখনো দাদা ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার দাবিটা ছাড়েননি, সঙ্গে বাড়তি যোগ করেছিলেন ডিসি (ডেপুটি কমিশনার) হওয়ার কথাটাও। কিন্তু দুঃখজনক হলো, নজিপুর স্কুলে থাকতে যে প্রতিযোগিতা করে লেখাপড়া করেছি, সেটা পরে আর ধরে রাখতে পারিনি। যদি সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারতাম, তা হলে আমি হলফ করে বলতে পারি, অবশ্যই দাদার ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিসি হওয়ার দাবি শতভাগ পূরণ করতে পারতাম। অবশ্য খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না কখনো, এ কথা যেমন সত্য তার চেয়েও কঠিন সত্য হলো, লেখাপড়ায় আমি মোটেও সিরিয়াস ছিলাম না । অর্থাৎ মনোযোগী ছাত্র বলতে যা বুঝায় তার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে ছিল না। শুধু সিনেমা দেখা আর খেলাধুলার চিন্তা সারাক্ষণ আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। গল্পের বই পড়াও এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়েছিল। কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাস পড়েছি অন্তত একাধিকবার করে। বইগুলো প্রায় মুখস্ত হয়েছিল।
দেবনাথ নামে এক ব্যাংকার আমাদের মেসমেম্বার ছিলেন। বয়সে আমার বেশ বড় হলেও তার সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। দেবনাথ বাবুকে আমি দাদা বলে সম্বোধন করতাম। ক্লাস এবং তার অফিস শেষে মেসে বসে আমরা নানা গল্প-গুজবে মেতে থাকতাম। একদিন সন্ধ্যার পর দেবনাথ দাদা আমাকে তার সঙ্গে তাঁতী বাজারে এক বাসায় নিয়ে গেলেন। তিনতলা বাড়ির বিশাল একটা রুমের মেঝেতে ফরাস বিছানো। বৃত্তাকার ভাবে বসে আছেন নানা বয়সী লোকজন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেবনাথ দাদা বললেন- ‘মান্নান, আজ আমি টাকা দিয়ে তাস খেলবো। তুমি আমার পিছনে বসবে। আমি মাঝে-মধ্যে তোমাকে কিছু টাকা রাখতে দিব। তুমি মেসে গিয়ে আমাকে দিয়ে দিবে। আমি হারতে থাকলে, এমনকি আমার হাত যদি একেবারে শূন্যও হয়ে যায়, তোমার কাছে টাকা চাইলে এক টাকাও দিবে না ।’
পয়সা দিয়ে তাস খেলা যায় আমি তা জানতাম না। খেলা শুরু হলো রাত ১১ টায়। আগে উপস্থিত লোকজনকে বিরিয়ানি দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। আমরাও পেটপুরে গরম গরম বিরিয়ানি খেলাম। বেশ আয়েস করেই বসেছেন তাসের আসরের খেলোয়াড় এবং তাদের সঙ্গে থাকা লোকজন। খেলা শুরু হলো, একজন তাস বন্টন করছেন ৭/৮ জন লোকের মধ্যে। প্রত্যেকের ভাগে তিনটে করে তাস দেয়া হলো। পরে জানলাম তিন তাসের এই জুয়াকে ফ্লাস বা তিন কার্ড খেলা বলা হয়।
বোর্ডে অর্থাৎ গোল হয়ে বসা লোকজনের মাঝখানে পূর্বেই নির্দিষ্ট অংকের টাকার দান ধরা ছিল। তাস না দেখে সবাই বেশি বেশি টাকার দান ধরছিলেন। তিন তাসের জুয়া খেলার পরিভাষায় একে বলা হয় ব্লাইন্ড হিট। ওই তাসের আসরে লোকজনের প্রায় বেশির ভাগই মাঝবয়সী হিন্দু সম্প্রদায়ের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী।
রাতভর খেলা চললো। মাঝে মধ্যে দেবনাথ দাদা আমাকে টাকা দেন আর আমি তা পকেটে পুরি। এভাবে সারারাতে আমার প্যান্টের দুই পকেট টাকায় ভর্তি হয়ে গেল। রাত সাড়ে ৩টার দিকে দেবনাথ দাদা আমার কাছে প্রথম টাকা চাইলেন। আমি বললাম- ‘দিব না।’ দাদা আমার উপর কপট রাগ দেখালেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারো টাকা চাইলেন। আমি আবারো বললাম- “দিব না।’ তারপর দাদা তাস খেলা বাদ দিয়ে মদ খাওয়া শুরু করলেন। এই সময় আমি তার কানে কানে বললাম- ‘চলেন দাদা এখন মেসে ফিরে যাই।’
আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। দেবনাথ দাদা কথা রাখলেন, আমরা মেসে ফিরে এলাম। তখনো ভোর হতে কিছুটা সময় বাকি। দেবনাথ দাদাকে বললাম, এই নিন আপনার টাকা, আমি গুণি নাই। দু’জন মিলে গুণে দেখলাম আমার দুই পকেটে রাখা টাকার অংক সাত হাজার তিনশ। ওই আমলে সাত হাজার টাকা, বিশাল অংকের তো বটেই। দেবনাথ দাদা আমাকে বারাবার ধন্যবাদ দিয়ে আমার হাতে কিছু টাকা গুজে দিলেন। এরপর দেবনাথ দাদা বহুবার আমাকে নিয়ে ওই তাসের আসরে নিয়ে যেতে চাইলেও আমি আর কোনদিন ওমুখো হইনি পুলিশের ভয়ে।
প্রতিদিনই বিকেলে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকি। এসব কাজের মধ্যে ছিল এলাকা থেকে ঢাকায় আসা ছাত্রদের মেসে সিট পাইয়ে দেয়া, ঢাকা এবং কলেজের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া ইত্যাদি। আমার এলাকা থেকে জগন্নাথ কলেজ এবং কায়দে আজম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) পড়তে আসা এমন ৬/৭ জন ছাত্রকে মেসে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। এদের মধ্যে ছিল শ্যামপুরের আমিনুল, সাদেক, নকুচার মোজাফ্ফর, বদলগাছির সাইদুর, মহাদেবপুরের বাবু ও আরো কয়েকজন। আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল কোটালীপাড়ার হানিফ-উজ-জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেনজির আহম্মেদ, বরিশালের নিশাত, সিলেটের হামিদুর প্রমুখ। আমি, বদলগাছির সাইদুর ও নকুচার মোজাফ্ফর মেসের একই রুমে থাকতাম। সাইদুর প্রতিদিন খুব সকালে মাখনের সঙ্গে পাউরুটি আর একটা ডিমভাজি দিয়ে আমাদের রুমে নাস্তা পরিবেশন করতো। এ কাজ করে খুব আনন্দ পেত এবং গর্ববোধ করতো সাইদুর।
*বিনা টিকিটে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়ার খেসারত*
ফুটবল খেলা বা দেখা আমার খুব ভালো লাগতো। তা এক নেশায় পরিণত হয়েছিল। জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় (১৯৬৮ সাল) ঢাকা স্টেডিয়ামে বিদেশি ফুটবল টিম রাশিয়া বনাম চীনের একটি ম্যাচ দেখতে গিয়ে পুলিশের লাঠিপেটার শিকারও হয়েছি। ঘটনার দিন তারিখ মনে নেই। তবে পুলিশের লাঠির আঘাতের কথা ভুলিনি এখনো। রাশিয়া বনাম চীনের এই ম্যাচটি দেখার জন্য আমরা দশ/বারোজন বন্ধু মিলে ঢাকা স্টেডিয়ামে গেলাম। মেসের এক বন্ধু বলল, আমার এক আত্মীয় স্টেডিয়ামের গেটে চাকরি করে। সে দশ/পনের জনের পাসের ব্যবস্থা করতে পারবে। তার কথা এত মনের আনন্দে আমরা হেঁটে হেঁটে স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখি ২ নম্বর গেটের সামনে বিরাট লাইন।
আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু লাইনে আমাদের চাইতে বড়দের সংখ্যা ছিল বেশি। প্রায় শ’পাঁচেক লোক তো হবেই। এদের চাপে আমাদের চিড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা। তবে মজার বিষয় হলো, লাইনে সবার হাতে হাতে টিকিট থাকলেও আমাদের কারো হাতে টিকিট ছিল না। কারণ, আমরা তো ফ্রি পাসের আশায় লাইনে দাঁড়িয়েছি। এ অবস্থায় পুলিশ টিকিট চেক শুরু করতেই লাইনে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ বেধড়ক লাঠি চার্জ শুরু করলো। সবার পড়ি কি মরি অবস্থা। বেধড়ক লাঠি চার্জে আমরা চারজন বেদম মার খেলাম। হাতে, পায়ে, মাথায় লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হলো কেউ কেউ। এজন্য হাসপাতালেও যেতে হয়েছিল আমাদের। খেলা দেখা হলো না। বিনা টিকিটে খেলা দেখার চেষ্টা, এই বোকামির কথা মনে হলেই এখনো আমার হাসি পায়।
চলমান …………………..
(গল্পটি ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করুন)