দর্শকদের ভোগান্তি, সাবেক ফুটবলাররা অপমানিত; শোধরাবে তো বাফুফে?

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচ। ফুটবলাঙ্গন ছাপিয়ে জাতীয় জীবনের যেন আলোচনার অংশ হয়েছিল এই খেলা। ফুটবলপ্রেমী বাংলাদেশি নাগরিকরা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গর্জে উঠেছিলেন। ‘বাংলাদেশ, হামজা, সামিত’ চিৎকারে প্রকম্পিত হলেও শেষ পর্যন্ত সফরকারী সিঙ্গাপুর জয় পেয়েছে।

বাংলাদেশের কালকের হারের পেছনে ফুটবলসংশ্লিষ্ট অনেকেই কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরাকে দায়ী করেন। ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তার কৌশলের ভুল নিয়ে প্রশ্ন হলে তিনি সরাসরি এড়িয়ে যান। কোচ নিজের ভুল এড়িয়ে গেলেও বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচে মাঠ ও মাঠের বাইরে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। যা দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য শিক্ষণীয়।

ফেডারেশনের অদূরদর্শিতায় দর্শকদের ভোগান্তি

ফুটবলের প্রাণ দর্শক। সেই দর্শকরা ফুটবলমুখো হয়েছেন। যা বাফুফের জন্য অত্যন্ত সুখকর দিক। দর্শকদের ফুটবলের সঙ্গে রাখার দায়িত্বটি এখন বাফুফের।

গতকালের অভিজ্ঞতা অবশ্য সাধারণ দর্শকদের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয়ে খেলা রাত নয়টা পর্যন্ত চলেছে। অথচ বাফুফের নির্দেশনায় দর্শকরা দুপুর দু’টার পর থেকে গ্যালারিতে প্রবেশ করেছেন। তীব্র গরমে গ্যালারিতে দর্শকরা পানির তৃষ্ণায় পড়েছিলেন। সেখানে পানির সংকট ছিল চরম।  অনেক দর্শকের অভিযোগ গরমের মধ্যে পানির বোতলও তারা গ্যালারিতে প্রবেশের সময় অনুমতি পায়নি।

কনসার্ট, ‘বাণিজ্য’ 

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে প্রথম হোম ম্যাচ। সেই হোম ম্যাচের আগে বাফুফে গতকাল কনসার্ট আয়োজন করেছিল কিছুক্ষণের জন্য। ঘরোয়া ফুটবলে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে এমন গান-বাজনার ঘটনা আগে কখনো হয়নি। 

বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচকে কেন্দ্র করে বাফুফের ২-১ জন কর্মকর্তা অনেক হাইপ উঠিয়েছিলেন। তাদের ব্রেণচাইল্ডেই কনসার্ট। ফুটবলসংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, ফুটবল ম্যাচের আগে এ রকম কনসার্ট একেবারে নিষ্প্রয়োজন। 

দর্শকরা মাঠে আসলে পৃষ্ঠপোষক আকর্ষণ করবে। সেই দর্শকদের অনেকেই কাল ‘জিম্মি’ ছিলেন। তীব্র গরমে একে ছিল পানির সংকট আবার অতি তীব্র মূল্যের অভিযোগও করেছেন অনেকে। গ্যালারিতে পানির মূল নির্ধারণই বাফুফের করা উচিত ছিল। দর্শকদের ফুটবল ভালোবাসা, আবেগকে পুজি করে ব্যবসায়ের এমন উপলক্ষ্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলছে আলোচনার ঝড়। 

বসুন্ধরা কিংস জাতীয় স্টেডিয়ামে এএফসি কাপের ম্যাচ আয়োজন করেছিল বছর চারেক আগে। সেই ম্যাচে তারা দর্শকদের জন্য স্বল্প দামে পানি ও চিপসের ব্যবস্থা করেছিল। দর্শকরা বিমুখ হলে তখন পৃষ্ঠপোষকরা উল্টো পথে হাটার শঙ্কা বহুগুণে।

সাবেক তারকাদের নেই ‘যথাযথ সম্মান’

বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাস কিংবা যে কোনো আলোচনায় এখনো রঙিন চরিত্র আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির, আলফাজ আহমেদরা। সাবেক এই তারকা ফুটবলাররা গতকালের ম্যাচে প্রাপ্য সম্মান পাননি। ষাটোর্ধ্ব বয়সী ফুটবলাররা গরমে ঘামে গ্যালারিতে বসেছিলেন। আসন ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে।

কথা কাটাকাটির মুহূর্তে সাবেক তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির

সাবেক জাতীয় ফুটবলার রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বির বলেন, ‘গতকাল নান্নু ভাইয়ের (ব্রাদার্সের সাবেক ফুটবলার) সঙ্গে বাজে আচরণ করা হয়েছিল। আমি এর প্রতিবাদ করায় আমার সঙ্গেও কথা কাটাকাটি হয়েছে। ফুটবল ম্যাচ দেখতে আমরা সাবেকরা এ রকম পরিস্থিতি প্রত্যাশা করি না মোটেও।’

আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই গুরুত্বপূর্ণ খেলায় সাবেক তারকাদের খেলার ফাঁকে ফাঁকে দেখানো হয়। এতে খেলার সৌন্দর্য্য আরো বাড়ে। গতকাল ফেডারেশন আমাদের যেখানে বসিয়েছে সেটার চেয়ে আরো সম্মান আমরা প্রাপ্য। গতকাল টিভিতে ফেডারেশনের দুই-একজনকেই কয়েকবার দেখা গেছে। যারা ফুটবলের সঙ্গে সেভাবে অতীতে কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না।’

দেশের অন্যতম প্রবীণ ফুটবলার শেখ আশরাফ আলী। তিনি আফসোস করে বলেন, ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কয়েকজন ফুটবলার জীবিত রয়েছে। তাদের এই ম্যাচে দাওয়াত দিতে পারত এমনকি যারা সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলেছিল তাদেরও। পূর্ববর্তী প্রজন্মকে সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।’

অব্যবস্থাপনা নিয়ে খোদ বাফুফে কর্তাদেরই ‘প্রশ্ন’

বাফুফে নিয়মিত স্টাফরাই বিগত সময়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করতেন। বড় খেলা/টুর্নামেন্ট হলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তা ও কিছু ভলান্টিয়ার নিয়োগ করতেন সাময়িক। বাফুফে এবার বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের জন্য বিভিন্ন সার্কুলার দিয়েছিল। এই ম্যাচ আয়োজনে একটি ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট, নিরাপত্তা ও ক্লিনিং ম্যানেজম্যান্টের টেন্ডার আহ্বান করেছিল। স্ব স্ব বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছে বাফুফে। পেশাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার পরও কেন গ্যালারির পরিবেশ নোংরা, সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত। বাফুফে নির্বাহী কমিটির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে বলেছেন, ‘এই ম্যাচের আগে দেখেছি অনেক টেন্ডার আহ্বান। যারা বিভিন্ন বিষয়ে কাজ পেয়েছে। তাদের কর্মকান্ড দৃশ্যমান সেভাবে হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই ভোগান্তি ও অব্যবস্থাপনা ছিল। নির্বাহী সভায় আমরা বিষয়গুলো জোরালোভাবে উপস্থাপন করব।’

হামজা ‘উদ্ধারকারী’, জাহাজ ঠিকের দায়িত্ব বাফুফের

বাংলাদেশের ফুটবলে ত্রাণকর্তা হয়ে এসেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ খেলা ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরি। তিনি বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার পর থেকেই ফুটবল উন্মাদনা তুঙ্গে। হামজা বাংলাদেশের জার্সিতে তিনটি ম্যাচ খেলেছেন। তিনটি ম্যাচই তার সেরাটাই দিয়েছেন। এরপরও এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের দুই ম্যাচের একটিতে ড্র ও আরেকটিতে হার। 

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের দুই ম্যাচের ফলাফল বাফুফেকে আরো পরিকল্পনা ও সংগঠিত হওয়ারই নির্দেশ দেয়। হামজা-সামিতরা বাংলাদেশের ফুটবলকে টেনে তুলবেন। সেই টেনে তুলতে হলে হামজাদের সতীর্থদের সামর্থ্যরেও উন্নতি ঘটাতে হবে। বাফুফেকে ঘরোয়া ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি, তৃণমূল ফুটবল জোরদার করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য অর্জনে এর কোনো বিকল্প নেই।

গোলের খেলা ফুটবলে গোল করতে হবে। টোটাল ফুটবলে যে কেউই গোল করার সুযোগ রয়েছে। গোলের মূল দায়িত্ব স্টাইকারের। বাংলাদেশের সেটার প্রবল সংকট। সেপ্টেম্বর উইন্ডোতে কিউবা মিচেল বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তত থাকবেন। তার দিকেই তাকিয়ে এখন বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা।
 
ক্যাম্পে অন্য রকম চিত্র 

বাফুফে স্পেনিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা দল নির্বাচন ও পরিচালনা ছাড়াও ক্যাম্প সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এবার সেই নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি রাখতে পারেননি। হামজা-সামিত আসার পর ফুটবলপ্রেমী ও গণমাধ্যমের আগ্রহ ছিল ব্যাপক। 

অনুশীলনের আগে-পরে অনেকেই হোটেলে ভিড় করেছিলেন। হামজা-সামিতদের নানা জনের আব্দার মেটাতে হয়েছে। ফেডারেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনাতেই মূলত হামজা-সামিতকে অনুরোধের ঢেকি গিলতে হয়েছিল বেশির ভাগ সময়। কোচ এতে নাখোশ থাকলেও ছিলেন নিরুপায়।