মুন্সীগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দিন দিন বেড়েই চলেছে দালালদের দৌরাত্ম্য। প্রতিদিন পাসপোর্ট অফিস খোলার আগে থেকেই গেটে অবস্থান করেন বেশ কয়েকজন দালাল। সেবাপ্রত্যাশী কেউ পাসপোর্ট অফিসের গেটে যাওয়া মাত্র তাকে ঘিরে ধরেন দালাল চক্রের এই সদস্যরা, দেন ঝামেলা ছাড়া পাসপোর্ট পাওয়ার নানা আশ্বাস। এভাবেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একেবারে নির্ভেজাল পাসপোর্ট পাওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন সাধারণ মানুষদের। বিশেষ করে পাসপোর্ট অফিস হতে দূরের উপজেলা ও চরাঞ্চল থেকে আসা মানুষজন সহজেই তাদের কথা বিশ্বাস করে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে পাসপোর্ট করাচ্ছেন।
জেলা শহরের খালিষ্ট এলাকায় অবস্থিত মুন্সীগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। এর আগে ২০১০ সালে জেলা শহরের মাঠপাড়ায় একটি ভাড়া ভবনে মুন্সীগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৬ সাল থেকে খালিষ্ট এলাকায় নিজস্ব ভবনে চলছে পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম।
শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে সরেজমিনে পাসপোর্ট অফিসের গেটে যাওয়া মাত্র এই প্রতিবেদককে দুইজন দালাল ঘিরে ধরে বলেন, পাসপোর্ট নবায়ন করবেন নাকি নতুন? এই প্রতিবেদক নতুন পাসপোর্ট করবেন বলতেই এদের মধ্যে রাসেল মিয়া নামের এক দালাল বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র দেন পাসপোর্ট করে দিচ্ছি। বিদুৎ বিল কার নামে? প্রতিবেদক জানান, তার বাবার নামে। এ সময় রাসেল মিয়া আশ্বাস দিয়ে বলেন, তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। সব কিছু আমরা করে দেব, সঙ্গে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সও।
কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে তিনি জানান, ১৫ দিনে পাসপোর্ট করলে ১১ হাজার, আর ৩০ দিনে করলে ৯ হাজার টাকা লাগবে।
পরে এই প্রতিবেদক পাসপোর্ট অফিসে ঢুকে দেখেন প্রায় দুই শ মানুষ পাসপোর্ট আবেদন করার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টা বাজলেও পাসপোর্ট কাউন্টারে কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে কাউন্টারে পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা নেওয়ার জন্য এক কর্মকর্তা প্রবেশ করেন। এরপর ওই কাউন্টারের পাশের কাউন্টারে পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়ার জন্য প্রবেশ করেন আরেক কর্মকর্তা।
এ সময় এই প্রতিবেদক আবার পাসপোর্ট অফিসের ভেতর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখেন গেটে দাঁড়িয়ে আছে দালাল চক্র। কেউ ঢুকলেই তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন পাসপোর্ট নবায়ন নাকি নতুন। বিভিন্নভাবে তাদের দিয়ে পাসপোর্ট করার জন্য প্রভাবিত করছেন।
পাসপোর্ট অফিসের গেটে দায়িত্ব পালন করছেন রাজু মিয়া নামের একজন আনসার সদস্য। তার সঙ্গে দালালদের বেশ সখ্যতা। রাজু নিজেও সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন নতুন পাসপোর্ট নাকি নবায়ন। মাঝেমধ্যে গেট থেকে সেবাপ্রত্যাশীদের লাইনে দাঁড় না করিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভেতরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসে ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করতে সরকার নির্ধারিত খরচ ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। এই পাসপোর্ট এক সপ্তাহের মধ্যে ডেলিভারি নিতে হলে ৮ হাজার ৫০ টাকা এবং দুই দিনে ডেলিভারি নিতে ১০ হাজার ২০০ টাকা জমা দিতে হবে। এর বাইরে অনলাইন আবেদনের জন্য দিতে হয় অতিরিক্ত ফি।
মুন্সীগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে ছাড়াও আশপাশের অনেক দোকানে অনলাইনে আবেদন করা যায়। অনলাইনে আবেদন করতে গেলেই ওই সমস্ত দালালরা প্রতারণার ফাঁদ ফেলে পাসপোর্ট করতে বিভিন্ন ঝামেলার কথা তুলে ধরে পাসপোর্ট অফিসে তাদের লোক রয়েছে বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন। অথচ দালালদের এ সমস্ত টোপ পেরিয়ে সরাসরি পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে আবেদন করলেই নিয়মমাফিক পাওয়া যাচ্ছে পাসপোর্ট। এ অবস্থা দিনের পর দিন চলতে থাকলেও নীরব পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
পাসপোর্ট অফিসে কথা হয় সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি তার পাসপোর্ট রিনিউ করতে এসেছেন। তিনি বলেন, গেটে আসামাত্র বেশ কয়েকজন দালাল আমাকে ঘিরে ধরে। ১৫ দিনের মধ্যে রিনিউ করে দেবে বলে আমার কাছে ১২ হাজার টাকা চান। আর এক মাসে দিলে নেবে ৯ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল বলেন, এখন মূলত কম সংখ্যক দালালই পাসপোর্ট অফিসের গেটে দাঁড়ান। দালালরা মূলত এখন অনলাইন আবেদনের অফিসেই বেশি অবস্থান করেন। মুন্সীগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস ও তার আশপাশের অনলাইন অফিসে ৫০/৬০ জন দালাল রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন উপজেলার হাটবাজারেও রয়েছে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন করার দোকান। তারাও টাকা নিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন করে পাসপোর্ট করে দিচ্ছেন।
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, মূলত ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে যখন কেউ ঝামেলায় পড়েন তখনই পাসপোর্ট অফিসের সামনে থাকা দালালরা সুযোগটা নেন। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে ঝামেলা হলেই দালালরা বলেন, আসেন আমরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এ বলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দাবি করেন। তখন সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে টাকার বিনিময়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে রাজি হন।
তখন দালালরা টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিসে যোগাযোগ করলে কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট করিয়ে দেন। মূলত দালাল পান তিন থেকে চার শ টাকা। বাকি টাকা পাসপোর্ট অফিসের লোকজন ভাগাভাগি করে নিয়ে থাকেন।
পাসপোর্ট নিতে অফিসে আসা টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামের শাহিন বলেন, গত ৩০ জানুয়ারি আমার গ্রামের এক লোকের মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদন করেছিলাম। এখন এসে পাসপোর্ট নিয়ে গেলাম। পাসপোর্ট করতে আমার কাছ থেকে ৯ হাজার টাকা নিয়েছে।
লৌহজং উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. শাহিন মিয়া বলেন, আমি অনলাইনে আবেদন করে পাসপোর্টের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছি। এক সপ্তাহ আগে পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা কিন্তু এখনো পাচ্ছি না। অফিসে এসে যোগাযোগ করলাম, অফিস বলছে আমার এক চোখে সমস্যা থাকার কারণে এখনো পাসপোর্ট হয়নি। আমাকে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে হবে।
শাহিন মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বসন্ত রোগে আমার এক চোখে একটু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু আমি এর আগেও তিনবার পাসপোর্ট করেছি। তখন তো কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট চায়নি!
টংগিবাড়ী উপজেলার পাঁচগাওঁ গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী বাদশা সেখের স্ত্রী সামিয়া স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট আবেদন করেছিলেন। তিনি রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ডেলিভারি নিতে এলে কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জ সুপার মার্কেট এলাকায় আমার দেবরের পরিচিত আলামিন নামের একজনের পাসপোর্টের জন্য অনলাইন আবেদন করার অফিস রয়েছে। তাকে ৯ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। আমরা শুধু পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমা দিয়েছি, আর এখন নিয়ে গেলাম। বাকি সব কাজ উনিই (আলামিন) করেছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ কামাল হোসেন খন্দকার বলেন, পাসপোর্ট অফিসে দালাল কোথায়? আমি তো কোনো দালাল দেখি না। এখন কেউ যদি পাসপোর্ট করতে গিয়ে তার এলাকার কোনো দালালকে টাকা দিয়ে আসে তাহলে তো আমার কিছু করার নেই।
তিনি আরও বলেন, পাসপোর্ট অফিসের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। আর যা আছে তা তো একদিনে সব পরিবর্তন করে ফেলতে পারব না।
এসব অভিযোগ নিয়ে কথা হয় মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা এর আগেও পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্বে থাকা আনসারকে ডেকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছি। আবারও খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।