দুবাইয়ে আটকার আগে সাকিবের দেশে ফেরা নিয়ে যত নাটকীয়তা

প্রায় ২১ দিনের ঘটনাপ্রবাহ। কানপুরে তপ্ত রোদের নিচে বলেছিলেন, এখানেই থামতে চান। সাকিব আল হাসান দেশের ক্রিকেটে দীর্ঘ দেড় যুগ পার করে বিদায় বলেন দুই ফরম্যাটকে। টি-টোয়েন্টির অবসর নিশ্চিত। ওয়ানডে অবসরের ডেডলাইন ২০২৫ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। আর টেস্টের জন্য দোদুল্যমান সিদ্ধান্ত। দেশে আসতে পারলে মিরপুরে অবসর। নয়ত শেষটা কানপুরেই। 

সাকিব আল হাসান চেয়েছিলেন শেষটা দেশে করতে। নিজের চেনা মাঠে। চেনা মানুষের সামনে। কিন্তু ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়টা ছিল না তার অনুকূলে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাকিব তখন অনেকের কাছেই খলনায়ক। সাকিব চাইলেন নিরাপত্তা। শুরুতে নেতিবাচক মন্তব্য। এরপর নম্র হলো বিসিবি ও সরকারের মনোভাব। বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকার উদ্দেশে যাত্রাও শুরু করেন সাকিব। 

কিন্তু থামতে হলো দুবাইয়ে। নাটকীয় এক পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে সাকিবকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো এই যাত্রায়। ২১ দিনের সেই দীর্ঘ ঘটনাপ্রবাহ দেখে নেওয়া যাক এক নজরে। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে এদিন অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব আল হাসান। কানপুরে ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের আগে বাংলাদেশের তারকা এই অলরাউন্ডার জানান, টি-টোয়েন্টিতে নিজের শেষ ম্যাচটা বিশ্বকাপেই খেলে ফেলেছেন তিনি। 

সঙ্গে এও বলেছিলেন, টেস্ট ক্রিকেটের বিদায়টা তিনি নেবেন ঘরের মাটি থেকে। আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে শেষবার বাংলাদেশের হয়ে সাদা পোশাকে দেখা যাবে তাকে। অবসরের কথা জানিয়ে সাকিব প্রেস কনফারেন্সে বলেন ‘আমার মনে হয় টি-টোয়েন্টিতে আমি আমার শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছি, মিরপুর টেস্টে (দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে) খেলতে পারলে সেটি হবে আমার শেষ টেস্ট’।
 
সাকিব নিজেও জানতেন দেশের পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সংসদ সদস্যের ওপর হামলার কথা জানতেন তিনিও। সেজন্যেই মিরপুরে বিদায়ী টেস্ট খেলার ঘোষণায় একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন সাকিব। 

সাকিব বলছিলেন, ‘আমি যেন গিয়ে খেলতে পারি এবং নিরাপদ অনুভব করি। যখন দেশের বাইরে আসার দরকার হবে, দেশের বাইরে আসতেও যেন আমার কোনো সমস্যা না হয়। বোর্ড খেয়াল রাখছে, বিষয়গুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তারা দেখছেন। তারা হয়তো আমাকে একটা সিদ্ধান্ত দেবেন, যেটার ভিত্তিতে আমি দেশে গিয়ে খুব ভালোভাবে খেলে অন্তত টেস্ট ফরম্যাটটা ছাড়তে পারব।’

নিজের অবসরের সিদ্ধান্ত ও দেশে ফেরা নিয়ে বিসিবির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে সাকিবের। তিনি বলেন, ‘দেশে যেহেতু অনেক পরিস্থিতি আছে, সবকিছু অবশ্যই আমার ওপর নির্ভর করছে না। আমি বিসিবির সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। তাদেরকে বলা হয়েছে আমার কী পরিকল্পনা। এই সিরিজ আর হোম সিরিজটা আমি ফিল করেছিলাম আমার শেষ সিরিজ হবে, টেস্ট ক্রিকেটে স্পেশালি।’

২৬ সেপ্টেম্বর, বিসিবির রেড সিগন্যাল 

সাকিবের প্রেস কনফারেন্সের ঘণ্টাখানেক পরই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ফারুক আহমেদ এলেন সংবাদ সম্মেলনে। বোর্ড সভা শেষে কথা বললেন সাকিবের অবসর আর নিরাপত্তা নিয়ে। সেখানেই জানালেন, ‘আমি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) তো আসলে কোনো এজেন্সি না। এটা বিসিবির হাতে না। সরকারের কাছ থেকে আসতে হবে নিরাপত্তা। দুই ধরনের নিরাপত্তা আছে। একটা মামলার, আরেকটা হচ্ছে সমর্থকদের।’

সাকিবের নিরাপত্তার ব্যাপারটি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসতে হবে বলেই মনে করেন ফারুক, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসতে হবে। বিসিবি কোনো এজেন্সি না, পুলিশ না, র‍্যাব না। সরকারের তরফ থেকে নিরাপত্তার ব্যাপারটি আসতে হবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।

২৯ সেপ্টেম্বর– ক্রীড়া উপদেষ্টার পাল্টা শর্ত 

সাকিবের নিরাপত্তা চাহিদার বিপরীতে এদিন পাল্টা শর্ত দিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ নিজেও। এক অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে বলেছিলেন, ‘সাকিব আল হাসানের পরিচয় দুটি, এটি মনে রাখতে হবে। তিনি একজন খেলোয়াড়। সে হিসেবে তার যতটা নিরাপত্তা দেয়া দরকার সেটা দেয়া হবে। অপরদিকে তিনি একজন রাজনীতিবিদও। আওয়ামী লীগের হয়ে রাজনীতি করেছেন।’ 

এসময় সাকিবের প্রতি অনেকটা শর্ত আরোপের সুরে উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে জনগণের মধ্যে যদি ক্ষোভ থাকে, তাহলে নিজেকেই তার সংশোধন করতে হবে। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান সাকিবকেই স্পষ্ট করতে হবে। আসিফ মাহমুদ যোগ করেন, ‘রাষ্ট্রের জায়গা থেকে রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককেই নিরাপত্তা দিতে বাধ্য এবং সেটা আমরা অবশ্যই করব।’

৪ অক্টোবর– ক্রীড়া উপদেষ্টার সুর নরম 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রথম নিজের সুর নরম করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় নারী টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে জানান, ব্যক্তিগতভাবে তিনি চান সাকিব আল হাসানের মতো একজন ক্রিকেটার দেশের মাটিতে খেলেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান। দেশে খেলতে এলে সাকিবকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।

ক্রীড়া উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি (সাকিব) এমন একজন খেলোয়াড়, যার দেশের জন্য অনেক অবদান রয়েছে। তিনি যেহেতু বাংলাদেশে নিজের শেষ টেস্ট খেলতে চান, আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই সেই ‍সুযোগ তিনি পান। আমাদের একজন খেলোয়াড়কে অবশ্যই আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেব। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে, সেটা ভিন্ন বিষয়। সেই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারি না, কারণ সেটা আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’ 

৯ই অক্টোবর– সাকিবের দুঃখপ্রকাশ 

ছাত্র আন্দোলনে নিজের নীরব ভূমিকার দায় অবশেষে মাথা পেতে নেন সাকিব আল হাসান। ফেসবুকে আসে তার দীর্ঘ পোস্ট। দায় মেনে নিয়ে সাকিব বলেন, এই সংকটকালীন সময়টাতে আমার সরব উপস্থিতি না থাকায় আপনারা যারা ব্যথিত হয়েছেন বা কষ্ট পেয়েছেন তাদের অনুভূতির জায়গাটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং এজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনাদের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এভাবে মনঃক্ষুণ্ন হতাম। 

দেশের মাটিতে সাদা পোশাকে শেষ ম্যাচ খেলার আকুতি জানিয়ে সাকিব বলেন, আপনারা জানেন, খুব শীঘ্রই আমি আমার শেষ ম্যাচটি খেলতে যাচ্ছি। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আজকের সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠা পর্যন্ত এই পুরো জার্নিটাকে ড্রাইভ করেছেন আপনারা। এই ক্রিকেটের এই গোটা গল্পটা আপনাদের হাতেই লেখা! তাই আমার শেষ ম্যাচে, এই গল্পের শেষ অধ্যায়ে, আমি আপনাদেরকে পাশে চাই।

১০ই অক্টোবর– মিরপুরে বিক্ষোভ 

সাকিবের ফেসবুক পোস্টের পরেই দেখা মেলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার। কিন্তু তাকে সুযোগ দিতে নারাজ অনেকেই। মিরপুরের শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে ১০ অক্টোবর রাতে জড়ো হয়েছিলেন বেশকিছু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী। সেখানে তারা দুই নম্বর গেটে সাকিবের ছবি টানিয়ে জুতাপেটা করেন। 

পরে স্টেডিয়াম এলাকাজুড়ে সাকিব বিরোধী গ্রাফিতি আঁকেন তারা। মিরপুর অঞ্চলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করা শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই সাকিবকে নিজেদের এলাকার স্টেডিয়ামে খেলতে দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন সেই রাতে। মিরপুরবাসী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ভোট চুরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং স্বৈরাচারের দোসর সাকিব যে কি না দেশবাসীর ক্রান্তিলগ্নে বিদেশের মাটিতে আনন্দময় সময় কাটাচ্ছিল, সে আর কোনোদিন যেন বাংলাদেশের জার্সি না গায়ে দেয় এবং মিরপুর মাঠে না আসে।

১৫ অক্টোবর– আসিফ মাহমুদের গ্রিন সিগন্যাল 

মামলা হলেও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের দেশে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আইনি বিষয় তো আইনি বিষয়, এটা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। একটা হচ্ছে সাবজুডিস, দ্বিতীয় হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কনসার্ন আছে, উত্তরটা দিতে পারবে।’ 

১৬ অক্টোবর– মিরপুর টেস্টের দলে সাকিব 

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের জন্য ১৫ সদস্যের স্কোয়াড ঘোষণা করে বিসিবি। দেশের মাটিতে বিদায়ী টেস্ট খেলার ইচ্ছাপ্রকাশ করা সাকিব আল হাসানকে নিয়েই দল সাজিয়েছে বাংলাদেশ। বিসিবি সূত্রে জানা যায়, ১৭ তারিখ রাতেই সাকিবের দেশে ফেরার কথা। 

১৬ অক্টোবর মধ্যরাত– দুবাইয়ে আটকালেন সাকিব 

বুধবার মধ্যরাতে তৈরি হলো নতুন জটিলতা। আপাতত সাকিবকে সংযুক্ত আরব আমিরাতেই থামতে হয়েছে। জানা গেল, নতুন করে সবুজ সংকেত পেলেই কেবল আসবেন ঢাকায়। মিরপুরে স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় গত কয়েকদিনের বিক্ষোভকে মাথায় নিয়েই সাকিব আল হাসানের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। আপাতত তাই সাকিবের দেশে ফেরা খানিক জটিলতায় পড়েছে। 

১৭ অক্টোবর– দেশে ফেরা হচ্ছে না সাকিবের 

নিরাপত্তার কথা ভেবেই সাবেক এই অধিনায়ককে দেশে ফিরতে না করা হয়েছে। বিপিএল ড্রাফটের পরেই দুবাই গিয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ। সঙ্গে ছিলেন বিসিবি সিইও নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজন। শোনা যাচ্ছে, সাকিবের সঙ্গে সেখানেই তাদের কথা হয়েছে।  

দেশের একাধিক গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে সাকিব নিজেও নিশ্চিত করেছেন এখনই দেশে আসা হচ্ছে না তার। এরপর অবশ্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতেই সাকিবকে দেশে আসতে নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। একইসঙ্গে বর্তমানে সাকিবের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মানুষের ক্ষোভের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন উপদেষ্টা।

টি-টোয়েন্টির মতো সাকিবের শেষ টেস্টও আপাতত দেশের বাইরেই নিশ্চিত হয়ে থাকল। কানপুরে ভারতের বিপক্ষে টেস্টই সাদা পোশাকে সাকিবের শেষ বলে ধরে নেওয়া যেতেই পারে এই পর্যায়ে।