ইউরোপিয়ান ফুটবল লিগে চলছে রমরমা ফুটবলের সূচি। নতুন বছর আসার পরপরই শুরু হয়েছে শীতকালীন দলবদলের সূচি। একইসঙ্গে মৌসুমের মাঝপথ শেষ হওয়ায় শিরোপা আর রেলিগেশনের লড়াইও আকার বুঝে নিয়ে শুরু করেছে। লড়াইয়ের পরিধি বোঝা যায় পয়েন্ট তালিকার দিকে তাকালে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষ ৫ দলের মাঝে পয়েন্ট পার্থক্য মোটে ৩। লা-লিগা আর সিরিআ তেও চলছে বড় রকমের লড়াই।
কিন্তু ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের এই ঠাসা সূচির মাঝেই জানুয়ারি মাসে শুরু হচ্ছে দুই মহাদেশের ফুটবল উৎসব। এশিয়ান মহাদেশের ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের আসর এএফসি এশিয়ান কাপ শুরু হবে ১২ই জানুয়ারি। চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি। আর আফ্রিকায় আফ্রিকান কাপ অব নেশন্স (আফকন) শুরু হবে ১৪ জানুয়ারি। আর ফাইনাল ১২ ফেব্রুয়ারি। আর এই সময়টায় খেলোয়াড়, দর্শক, টিভিস্বত্ত্বসহ বড় রকমের ক্ষতির মুখে থাকবে ইউরোপের লিগগুলো।
চলতি বছরে মাঠে গড়াবে ৪ মহাদেশীয় আসর
জানুয়ারিতেই কেন এমন সূচি?
ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের সঙ্গে যেকোনো রকমের সংঘর্ষ এড়াতে নিজেদের মহাদেশীয় আসরের সময়সূচিতে পরিবর্তন এনেছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা কনমেবল। বর্তমানে ইউরোর সময়ে কোপা আমেরিকা আয়োজন করছে কনমেবল। ২০২১ সালে একইদিনে হয়েছিল দুই মহাদেশীয় আসরের ফাইনাল। ২০২৪ সালেও তাইই হবে। যদিও এদিক থেকে ব্যতিক্রম এশিয়া এবং আফ্রিকা।
মূলত এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের আবহাওয়া এবং মহামারি করোনার বিবেচনায় রেখেই এমন সূচিতে নিজেদের খেলার আয়োজন করা হয় এই দুই মহাদেশে। আফ্রিকা কাপ অব নেশনস ও এএফসি এশিয়ান কাপও বাকি দুই মহাদেশীয় আসরের মতো আন্তর্জাতিক বিরতির সময়েই হওয়ায় কথা ছিল।
এএফসি এশিয়ান কাপ
এশিয়ান কাপের আয়োজন স্বত্ব ছিল করোনার উৎপত্তিস্থল চীন। টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল গত বছরের জুন জুলাইয়ের বিরতিতে। কিন্তু চীনের ‘জিরো কোভিড’ নীতির কারণে টুর্নামেন্ট সরিয়ে নেওয়া হয় কাতারে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে সেই সময় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠে।
ঠিক এইকারণে ২০২২ সালে বিশ্বকাপ হয়েছিল নভেম্বর-ডিসেম্বরে। এবার সেই আবহাওয়া বিবেচনাতেই কাতারে এশিয়ান কাপের টুর্নামেন্ট পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে। একইভাবে জুন–জুলাইয়ে আইভরি কোস্টে গ্রীষ্মকাল হওয়ায় আফ্রিকা কাপ অব নেশনস শীতের সময়ে অনুষ্ঠিত হবে।
যদিও জার্মানিতে ইউরো আগামী বছরের ১৪ জুন শুরু হবে। ফাইনাল ১৪ জুলাই। আর যুক্তরাষ্ট্রে কোপা আমেরিকা শুরু হবে ২০ জুন, শেষ হবে ইউরোর মতোই ১৪ জুলাই।
আফ্রিকান কাপ অব নেশন্স
বিপাকে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো
ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের রমরমা এই সূচির মাঝেই এবার খেলোয়াড়দের ছেড়ে দেওয়া বা ধরে রাখা নিয়ে ঝামেলায় জড়াতে হচ্ছে ক্লাবগুলোকে। আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশের ফুটবলাররা নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। ক্লাবগুলোও তাদের ছেড়ে দিতে অনেকটা বাধ্য।
একই সময়ে ক্লাব ও দেশের খেলা থাকলে কোনো খেলোয়াড় কোন দলের হয়ে খেলবেন, তা পুরোপুরি নির্ভর করে ক্লাবের সিদ্ধান্তের ওপর। ক্লাবগুলো চাইলে খেলোয়াড়দের অনাপত্তিপত্র নাও দিতে পারে। কিন্তু অনাপত্তিপত্র না পেলে খেলোয়াড় এবং ক্লাবের সম্পর্ক অবনতিসহ নানামুখী চাপের মধ্যেই থাকতে হয় ক্লাবগুলোকে। বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে তাই দেওয়া হয় ছাড়পত্র।
বড় তারকাদের মিস করবে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো
আর এতে প্রভাব পড়ে পারফরম্যান্সে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে একইসঙ্গে লিভারপুল ছেড়ে দিয়েছিল তাদের বড় দুই তারকা সাদিও মানে এবং মোহাম্মদ সালাহকে। যার ফলে পুরো জানুয়ারি মাসে কোনো জয়ই আসেনি তাদের ভাগ্যে। শিরোপা রেসেও পরে ছিটকে যায় অলরেডরা। আফ্রিকান খেলোয়াড়দের উপর নির্ভরশীল ক্লাবটি ভুগেছে ২০২১ সালে এসেও।
এবারেও তাদের বড় তারকা মোহাম্মদ সালাহ কমপক্ষে ৫টি লিগ ম্যাচ মিস করবেন আফকনের কারণে। শুধু লিভারপুলই না, ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগেই চলবে এমন দশা। সালাহ ছাড়াও ভিক্টর ওসিমেন, সন হিউং মিন, সোফিয়ান আমরাবাত, আন্দ্রে ওনানা, স্যামুয়েল চুকুয়েজে, কাং ইন লি, ওয়াতারু এন্দোদের মতো পরিচিত মুখদের অন্তত এক মাস ক্লাবের হয়ে খেলতে দেখা যাবে না।
কত ম্যাচ আফ্রিকান খেলোয়াড়দের পাবে না ক্লাবগুলো?
মোটাদাগে হিসেব করলে অন্তত ১ মাসের জন্য আফ্রিকান এবং এশিয়ান খেলোয়াড়দের স্কোয়াডে পাবে না ইউরোপের ক্লাবগুলো। এজন্য তারা মিস করতে পারে ৫টি লিগ ম্যাচ। এছাড়া ঘরোয়া এবং ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতাতেও আছে একাধিক ম্যাচ। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তত ৮ ম্যাচ এসব খেলোয়াড়ের সার্ভিস পাবে না ইউরোপের বড় ক্লাবগুলো।
এছাড়া, সামগ্রিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে লিগগুলো। ইতালিয়ান সিরি ‘আ’ থেকে ৫১ জন খেলোয়াড় ক্লাব ছেড়ে যাবেন। ৫০ জন খেলোয়াড় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে পাড়ি জমাবেন নিজের দেশে। জার্মান বুন্দেসলিগার ও স্পেনিশ লা লিগা থেকেও অনেক চলে যাবেন দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে।
আর্থিক এবং অন্যান্য জটিলতা
পরিসংখ্যান বলছে, ফুটবলের সবচেয়ে বড় বাজার এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে। এশিয়ার ৪৫৬ কোটি এবং আফ্রিকার ১২১ কোটি মানুষ ইউরোপিয়ান ফুটবল বাজারের সবচেয়ে বড় দর্শক। এই দুই মহাদেশে আসর মানে, নজর ইউরোপ থেকে অনেকটাই সরে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই টিভিস্বত্ত্ব থেকে শুরু করে প্রবাসী দর্শক, সবদিক থেকেই পড়বে এর প্রভাব।
আফ্রিকান কাপ অব নেশনস ও এএফসি এশিয়ান কাপে চোখ রাখবেন এই দুই মহাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। অনেক সমর্থক আবার মাঠে গিয়ে নিজ দেশকে সমর্থন জানাতে আয়োজক দেশ আইভরি কোস্ট ও কাতারে যাবেন। তারাও ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের ওপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলবেন। এছাড়া তারকাদের অনুপস্থিতিও টিভিতে দর্শকদের আগ্রহ হারানোর কারণ হবে।
জেএ