পাকিস্তানকে সিরিজ হারিয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বেশি নাকি লোকসান?

টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে সিরিজ হারাল বাংলাদেশ। ধবলধোলাইয়েরও সুযোগ ছিল। যদিও তেমন কিছু হয়নি তৃতীয় ও শেষ টি-টোয়েন্টিতে বড় ব্যবধানে হারায়। এদিকে, সিরিজ জয়ের পরেও সমীকরণ মেলাতে হচ্ছে– টাইগারদের জন্য এমন ক্রিকেট ক্ষতি নাকি লাভের যোগান দেবে! মিরপুরের স্লো উইকেটে ম্যাচ জয় এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে আদৌ কতটা কাজে দেবে সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি সিরিজের তিনটি ম্যাচই হয়েছে মিরপুরের শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে। এখনকার উইকেট স্লো ও লো ম্যাচের জন্য পরিচিত। যদিও গতকাল শেষ ম্যাচটি ছিল কিছুটা ব্যাটিং বান্ধব। এর আগে লো স্কোরিং দুটি ম্যাচের পর বাংলাদেশের ব্যাটাররা কালকের উইকেটেও বেশ খাবি খেয়েছে। সবমিলিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত সিরিজে লিটন-তাসকিনদের ঝুলিতে কী প্রাপ্তি, আর বৃহৎ অর্থে কেমন লোকসান হলো তা একনজরে দেখা যেতে পারে।

প্রথম সিরিজ জয়
বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের বিপক্ষে টি‑টোয়েন্টি সিরিজ জিতলো। পাকিস্তান এর আগে কখনোই বাংলাদেশের বিপক্ষে টি‑টোয়েন্টি সিরিজে হারেনি। ম্যাচের পরিসংখ্যানেও ছিল তাদেরই দাপট। ২২ বারের দেখায় ১৯টিতেই জিতেছিল পাকিস্তান। এবার ২৫ ম্যাচে বাংলাদেশ সেই ব্যবধান (২০–৫) কিছুটা ঘুচিয়েছে। ইতিহাসের পাতায় প্রথম এই সিরিজ জয় বাংলাদেশের জন্য গর্বেরই বটে।

আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি

পাকিস্তানের মতো বড় দলের বিপক্ষে জয়ের ফলে নিশ্চিতভাবেই আত্মবিশ্বাসের পারদটা বেড়েছে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের। যা জ্বালানি হিসেবে আসন্ন এশিয়া কাপ বিশ্বকাপ বা বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে মানসিকভাবে দৃঢ় থাকার পাশাপাশি বড় দলের বিপক্ষে প্রেরণা জোগাবে।

dhakapost
লো স্কোরিং সিরিজে ৩ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৭১ রান করে সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতেছেন জাকের আলী অনিক 

তরুণদের লড়াকু মনোভাব

এই সিরিজে ভালো পারফর্ম করেছেন তরুণ ক্রিকেটাররা। ঠিক ধারাবাহিক হতে না পারলেও কেউ না কেউ প্রতি ম্যাচেই ম্যাচে মোমেন্টাম তৈরির চেষ্টা চালিয়েছেন। সামনে যেহেতু বেশ কয়েকটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, সেসব মঞ্চেও জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন সাম্প্রতিক সিরিজে ভালো করা ক্রিকেটাররা।

র‍্যাঙ্কিং এবং আইসিসি পয়েন্ট
সিরিজ জয়ের মাধ্যমে টি‑টোয়েন্টি র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হবে। অবশ্য পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করতে পারলে তালিকায় এগোতে পারত বাংলাদেশ। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবে ক্রিকেটাররাও র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি করছেন। মুস্তাফিজুর রহমান টি-টোয়েন্টিতে এখন ৯ নম্বর বোলার। 

দেশীয় ক্রিকেটের ভাবমূর্তি
গত বছরটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ছিল অনেকটাই গড়পড়তা মানের। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে পরপর দুটি সিরিজ জয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নিজেদের সক্ষমতার আবারও জানান দিলো। যদিও ‘আন্ডারডগ’ তকমা পাওয়া দেশগুলো যেভাবে ক্রিকেটীয় উন্নতি করছে, সে হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিজ্ঞ বাংলাদেশেরও ম্যাচ জয়ের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। 

ব্যাটারদের অধারাবাহিকতা 
তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টিতে কোনো ব্যাটারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। নাঈম শেখ-লিটন দাসরা হতাশ করেছেন বারবার। ওপেনিংয়েও ছিল না ধারাবাহিকতার ছাপ। তবে এই সিরিজে ওপেনিং পজিশনে বারবার পরিবর্তন দেখা গেছে। তানজিদ তামিম ও পারভেজ হোসেন ইমনের বাইরে নাঈম সুযোগ পেলেও তিনি তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ।

অভিযোগের তিরে বিদ্ধ মিরপুরের উইকেট
আগে অনেকবারই মিরপুরের স্লো উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও আপত্তি জানিয়েছেন। এখানে দাপট নিয়ে জয়ের পর স্পোর্টিং উইকেটে সংগ্রাম করতে দেখা গেছে তাদের। টি-টোয়েন্টিতেও এমন উইকেট লম্বা সময়ের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। প্রথম ম্যাচের পরই পাকিস্তানের কোচ মাইক হেসন ‘আন্তর্জাতিক মানের উইকেট নয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। সে কারণে বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে এমন উইকেটে খেলা কতটা যৌক্তিক সেই আলোচনা চলছে। 

উদ্দীপনা ফিরল গ্যালারিতে
লম্বা সময় পর ঘরের মাঠে সিরিজ জয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত দেশের ক্রিকেটভক্তরা। প্রতিটি ম্যাচেই মাঠে ছিল ভরপুর দর্শক এবং তারা ফিরেছেন তৃপ্তি নিয়ে। এর আগ্রহ হারাতে বসা আবেগের ক্রিকেট নিয়ে আবারও উদ্দীপনা বাড়তে শুরু করেছে। 

বহুল আলোচিত মিরপুরের উইকেট নিয়ে যোগাযোগ করা হয় বিসিবির একজন কিউরেটরের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানিয়েছেন, ‘বৃষ্টির সময় বৃষ্টি হবে। শুকনো সময়ে মাঠ শুকনো থাকবে, এর মধ্যেই তো খেলা চলবে। বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স যেমনটা চেয়েছে, সে অনুযায়ীই উইকেট হয়েছে। আমাদের কাছে যেমন চায় আমরা তো তেমনই দিতে বাধ্য থাকি। পৃথিবীর সকল বোর্ডেরই তো একটা পলিসি থাকে।’

তবে বাংলাদেশ দলের উন্নতি হচ্ছে বলেই মনে করেন বিসিবি পরিচালক ও বিপিএল কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুব আনাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন, ‘দলটা এখন দাঁড়াচ্ছে কিন্তু, সবকিছু একটা প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যায়। কিছুদিন আগে আমরা শ্রীলঙ্কাকে তাদের মাটিতে হারিয়েছি। এবার পাকিস্তানকে হারালাম। তবে এটা খুব যে বড় অর্জন সেটা বলব না, শেষটা হেরেছি। টি-টোয়েন্টিতে আমাদের খেলোয়াড়রা এখনও সেটেল হচ্ছে।’ 

‘এই দলটার একটা বেসিক জিনিস খেয়াল করবেন যে, আন্ডার নাইনটিন বিশ্বকাপ জয় করা কিন্তু অধিকাংশ ক্রিকেটার এই দলে রয়েছে। আমাদের জন্য একটা ভালো দিক হবে যদি এই টিমটা দাঁড়িয়ে যেতে পারে’, আরও যোগ করেন বিসিবির এই পরিচালক।

দলের সাবেক নির্বাচক ও বর্তমান কোচ হান্নান সরকার অবশ্য এই সিরিজ জয়কে ক্ষতি হিসেবে দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি আসলে পজিটিভভাবে চিন্তা করতে চাই। আমরা জানি যে আমাদের টি-টোয়েন্টি দলটা এখনও গোছানোর পথে আছে। সামনের বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, তার আগে যে ম্যাচগুলো পাব সেগুলোর মধ্যেই তো আমাদের দলটাকে সেটেল করতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘স্কোয়াডের বাইরে আরও কয়েকজন ক্রিকেটারকে রেডি রাখতে হবে। সেই জায়গা থেকে গত কালকের ম্যাচেও কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলানো হয়েছে পাঁচজনকে। যদি সেই চিন্তা থাকতো তাহলে কিন্তু এত পরিবর্তন হত না। একটা উইনিং দল ভেঙ্গে নতুন দল করা হয়েছিল। ফলে মোমেন্টামে কিছুটা ব্যাক ফায়ার করতে পারে।’ 

ঘরের মাঠের এই জয়ে নেতিবাচক কিছু দেখতে চান না হান্নান, ‘আমি এটা নেগেটিভলি দেখতে চাই না। বড় স্বপ্ন দেখতে চাইলে কিছু কিছু জায়গায় আমাদের কম্প্রোমাইজ করতে হবে। আর যেকোনো দলের বিপক্ষে সিরিজ জয় অবশ্যই পজেটিভ। ম্যাচ জেতার অভ্যাসটা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এটা খুবই কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। আমরা পরপর দুইটা সিরিজ জিতলাম, এটা নিশ্চিত করেই দলের পরিবেশ ভালো করবে, কিছুটা আত্মবিশ্বাসও থাকবে।’

স্লো পিচেও ম্যাচ জিততে পারার সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক এই নির্বাচক, ‘স্বাভাবিকভাবে কন্ডিশন আমাদের একটু সুবিধা দিয়েছে। তবে উইকেটের দোষ দিয়ে পার পেয়ে যাব ব্যাপারটা এরকম না। পাশাপাশি বেশি লাভ হয়েছে এটাও আমি বলব না, লাভ-ক্ষতিতে যাব না। আমরা সিরিজ জিতেছি সেটা অবশ্যই প্রাপ্তি। এরকম কন্ডিশনে কিভাবে জিততে হয় সেটা শেখারও দরকার আছে। শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সঙ্গেও মিলিয়ে দেখতে পারি, যেটা আমেরিকায় হয়েছিল।’