নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দমনপীড়নের মধ্যেই পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই গঠিত হবে পরবর্তী সরকার। যদিও নির্বাচন এবং এতে কারা বিজয়ী হবেন, তাতে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলেই মনে করা হয়।
এই নির্বাচনে অন্যান্য বড় দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ইমরান খান নিজে দণ্ডিত হয়ে নির্বাচনের বাইরে আছেন। আদালতে দলীয় প্রতীক বাতিল হওয়ায় তার দলের প্রার্থীরাও লড়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান তো বটেই, এমনকি সরকারের গঠন কিংবা পতনের মতো বিষয়গুলোতেও অতীতে দেশটির সামরিক বাহিনীর ভূমিকা দেখা গেছে। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণ কী?
আর নির্বাচনের বাইরে থাকা ইমরান খানের ভবিষ্যতই বা এখন কোন দিকে যাচ্ছে? এমন প্রশ্ন এখন পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। সামরিক বাহিনী কীভাবে রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠল?
এটার উত্তর লুকিয়ে আছে দেশটির ইতিহাসে। আরো স্পষ্ট করে বললে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরবর্তী কয়েক বছরে। এখানে চারটি ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু।
দ্বিতীয় ঘটনা, জিন্নাহর মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় দেশটির আরেক শীর্ষ নেতা এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের গুলিতে নিহত হওয়া। এই দুই মৃত্যু পাকিস্তানের রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি করেছিল।
তৃতীয় ঘটনা হচ্ছে, এই একই সময়ে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দেশটিতে নিরাপত্তা সংকটও তৈরি করে। দেশটির সেনাবাহিনী নিরাপত্তা এবং বিদেশ নীতিতে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তুষ্ট ছিল না।
চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, দেশটির রাজনৈতিক নেতারা এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে না নিয়ে একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। যেটা পরে দেশে অনৈক্য তৈরি করে।
এসব কিছু মিলেই পাকিস্তানে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যেটা দেশটির সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ের গবেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুর দিকেই যখন রাজনৈতিক নেতৃত্বে দুর্বলতা এবং অনৈক্য স্পষ্ট হচ্ছিল, তখন এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশটির সামরিক বাহিনী ছিল এককভাবে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এমনটা হলে সামরিক শক্তির ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হয়। পাকিস্তানেও সেটা হয়েছিল।
‘‘পাকিস্তানে রাষ্ট্র কাঠামোয় সেনাশক্তি প্রথম আসে ১৯৫৪ সালে। তখন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বানানো হয়েছিলো, সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে। এই আইয়ুব খানই ১৯৫৮ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে নেন। সেখান থেকেই এটার শুরু,’’ বলছিলেন ড. সিদ্দিকা।
• সামরিক শক্তিই কি সব?
আইয়ুব খানের পর পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে আরো দুটি। সব মিলিয়ে দেশটির প্রায় ৭৭ বছরের ইতিহাসে সামরিক শাসন চলেছে ৩৩ বছরেরও বেশি। পাকিস্তানে সরাসরি এই সেনা শাসন দেশটির সব ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রভাব বলয় তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য যে নিকট অতীতে, বিশেষত ২০০৭ সালের পারভেজ মোশাররফের বিদায়ের পর গত ১৬ বছরে দেশটিতে আর কোন সামরিক অভ্যুত্থান হয়নি। দেশটির ইতিহাসে সেনা অভ্যুত্থান ছাড়া একটানা দীর্ঘ বেসামরিক শাসন এটাই।
কিন্তু এরপরও দেশটিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমেনি। কারণ বন্দুকের শক্তি ছাড়াও সেনাবাহিনীর দেশটিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী শক্তি হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে। আর আছে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা।
পাকিস্তানের সামরিক বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল বলেন, পাকিস্তানে একটা ন্যারেটিভ আছে যে, আর্মি ছাড়া পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ দেশটিতে বহু জাতি, বহু বিভক্তি এবং নিরাপত্তার বহু সংকট আছে। ফলে সেখানে আর্মি পাকিস্তানকে টিকিয়ে রেখেছে। এটা হচ্ছে সামরিক দিক।
‘‘এর বাইরেও আর্মি বাণিজ্যিকভাবেও শক্তিশালী এবং জনগণের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা আছে। তার চেয়ে বড় কথা রাজনৈতিক দলগুলোই সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করার অজুহাত তৈরি করে দিচ্ছে।’’
তার মতে, এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন সবচেয়ে বড় এজেন্ডা হয়ে ওঠে পাকিস্তানে। রাজনৈতিক দলগুলো কেন সামরিক বলয়ে? পাকিস্তানে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৯৯৯ সালে। সে সময় ক্ষমতায় আসা পারভেজ মোশাররফের বিদায় ঘটে ২০০৭ সালে।
এরপর পাকিস্তানে আর কোন সামরিক শাসন আসেনি। এই সময়ে দেশ চালিয়েছে মূলত বেসামরিক প্রশাসন। কিন্তু দেশটিতে অস্থিরতা আগের মতোই চলতে থাকে। অতীতের মতো এই সময়েও কোনও প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
পারভেজ মোশাররফ রাজনীতিতে ফিরে ক্ষমতায় আসলেও আবারও তাকে বিদায় নিতে হয়। একইভাবে ইমরান খান ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসীন হলেও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। পাকিস্তানে এমনসব ঘটনার পেছনে সামরিক বাহিনীই কলকাঠি নেড়েছে বলে মনে করা হয়।
কিন্তু ১৬ বছরের বেসামরিক শাসন সত্ত্বেও পাকিস্তানের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেনা নিয়ন্ত্রণ থেকে কেন বের হতে পারছে না? ড. আয়েশা সিদ্দিকার মতে, এর কারণ হচ্ছে নেপথ্যে থেকে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ এখনও সেনাবাহিনীর হাতেই রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী আগে রাজনীতিতে যেভাবে হস্তক্ষেপ করত, সেটাতে এখন তারা পরিবর্তন এনেছে। এখন তারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটাকে আমি বলি সামরিক আইন ছাড়াই সামরিক শাসন।
আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তানের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টই মূলত রাজনীতিতে নানা অস্থিরতা তৈরি করে রেখেছে। তারা এক দলকে অন্য দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পেরেছে। এছাড়া প্রতি ১০ /১৫ বছর পরপর নতুন কোন নেতাকে তারা সামনে নিয়ে আসছে।
‘‘ওখানে রাজনৈতিক নেতারাও শর্টকাটে ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী। এজন্য তারা সামরিক শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এভাবেই সামরিক বাহিনী এখানে শক্তির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হওয়ায় এই ভরকেন্দ্রের বাইরে যেতে পারছে না, বলেন ড. সিদ্দিকা।
• ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী?
এতো কিছুর মধ্যেই এখন এটা স্পষ্ট, পাকিস্তানের নির্বাচনে এখন যে দলই জিতুক তাকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করেই ক্ষমতায় আসতে এবং থাকতে হবে। কিন্তু তাহলে সেনা নিয়ন্ত্রণের এই রাজনীতিতে ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী? তার দল এবং রাজনীতি কি টিকে থাকতে পারবে? দেশটির সামরিক বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল বলছেন, ইমরানের সামনে সে সুযোগ আছে এখনও।
‘‘এর বড় কারণ হচ্ছে, তার বড় রাজনৈতিক সমর্থক গোষ্ঠী আছে। তার দল নির্বাচনে জিতে যাবে এমনটা কেউ আশা করছে না। কিন্তু পরাজিত হলেও তার প্রার্থীরা যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে জিতে আসতে পারে, তাহলে সেটা তাকে সরকার এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে দর কষাকষির শক্তি এনে দেবে।’’
‘‘এছাড়া তিনি পিপিপি, জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোর সঙ্গেও সমঝোতায় গিযে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করতে পারেন। সুতরাং ইমরান খানের রাজনীতির ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়নি।’’
পাকিস্তানে এর আগেও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্ষমতা ছাড়ার, এমনকি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ারও ইতিহাস আছে। পরে আবারও সোবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতায় রাজনীতিতে ফিরে আসার নজিরও আছে। নওয়াজ শরিফ নিজেই একাধিকবার সে উদাহারণ তৈরি করেছেন।
ফলে যে কোন নতুন রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ইমরান খানেরও সে সুযোগ আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যে নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো খুব সহসাই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিবিসি বাংলা।