পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান ও ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর শর্তে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) দলের সাথে পিপিপি সমঝোতায় রাজি আছে বলে জানিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পিপিকে দেওয়া হলে শেহবাজ শরিফের দলের সাথে পিপিপি জোট সরকার গঠন করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পিএমএল-এনের প্রেসিডেন্ট শেহবাজ শরিফের সাথে বৈঠকে এসব শর্ত দিয়েছেন আসিফ আলী জারদারি। রোববার নিজ দলের নেতাদের পিপিপির এসব শর্তের কথা জানিয়েছেন শেহবাজ শরিফ।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল পিপিপি ও পিএমএল-এনের সূত্রের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পিএমএল-এনের সাথে পিপিপি জোট সরকার গঠনে রাজি হয়েছে। তবে বিলাওয়ালকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর শর্ত দিয়েছে দলটি। পিএমএল-এনের নেতাদের শেহবাজ শরিফ বলেছেন, এসব শর্তের বিনিময়ে পাঞ্জাবেও পিএমএল-এনকে সরকার গঠনে সমর্থন জানাবে পিপিপি।
পিএমএল-এনের সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য নিউজ বলেছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ শুক্রবার রাতে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ও পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির সাথে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে ভবিষ্যৎ জোট সরকার নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা। শনিবার দলটির একটি সূত্র জানায়, পিএমএল-এনের নেতারা কেন্দ্রের পাশাপাশি পাঞ্জাবেও ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এই বিষয়ে শনিবার শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পিএমএল-এনের নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে সিনেটর ইসহাক দার, খাজা সাদ রফিক, সরদার আয়াজ সাদিক, মরিয়ম আওরঙ্গজেব, মালিক মুহাম্মদ আহমদ খান, সিনেটর আজম নাজির তারার, আতাউল্লাহ তারার, খাজা ইমরান নাজির ও অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সরকার গঠনের বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেন পিএমএল-এনের প্রেসিডেন্ট শেহবাজ শরিফ। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পিএমএল-এন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে আবির্ভূত হলেও নিজেরা সরকার গঠন করতে পারছে না। দেশটিতে সরকার গঠনের জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সহায়তা প্রয়োজন।
বৈঠকে নির্বাচনের ফলের সঙ্গে প্রত্যাশার কোনও মিল না থাকায় পিএমএল-এনের নেতারা বিস্ময় প্রকাশ করেন বলে দলটির সূত্র জানিয়েছে। তারা বলেছেন, ‘‘নির্বাচনের ফলাফল তাদের প্রত্যাশার তুলনায় একেবারে ভিন্ন। নওয়াজ শরিফ, মরিয়ম নওয়াজ এবং অন্যান্য পিএমএল-এন নেতারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। একই সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতারা জনসভা, মানুষের দ্বারে-দ্বারে প্রচারণা, গণপ্রচারণা ও ভোটারদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেয়নি, বিশেষ করে নির্বাচনের দিনে।’’
নির্বাচনের তিনদিন পর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে রোববার। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০১টি আসন জিতেছেন। যার মধ্যে ৯৬টি আসনে জিতেছেন ইমরান খানের পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৫টি আসনে জয় পেয়েছে।
এ ছাড়া প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৫৪টি আসনে জয় পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। করাচি-ভিত্তিক দল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) ১৭টি আসন জিতেছে।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ২৬৬টি আসনে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য কোনও দল বা জোটকে ১৩৪টি আসন পেতে হবে। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে খাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশের একটি আসনের ভোট বাতিল করা হয়েছে এবং পাঞ্জাবের অন্য একটি আসনের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।
কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দেশটিতে সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠনে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির সাথে জোট করাই পিএমএল-এনের প্রথম বিকল্প। কিন্তু পিপিপি জোট সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পিএমএল-এনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করেছে। তবে এই বিষয়ে পিএমএল-এন এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি।
পিএমএল-এনের একাধিক সূত্র দাবি করেছে, যদি পিপিপির সাথে আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে এমকিউএম, জেইউআই-এফ, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ছোট দলগুলোকে সাথে নিয়ে পিএমএল-এন জোট সরকার গঠন করবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে পিএমএল-এনের প্রেসিডেন্ট শেহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী এবং মরিয়ম নওয়াজকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী করা হবে।
এর বাইরেও দলটির নেতাদের কেন্দ্রে, পাঞ্জাব এবং বেলুচিস্তান প্রদেশেও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিকল্প উপায় নিয়ে ভাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে পিএমএল-এনের সূত্রগুলো দাবি করেছে। এদিকে, শনিবার পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেছিলেন, তার দলের সমর্থন ছাড়া কেন্দ্রের পাশাপাশি দুটি প্রদেশ— পাঞ্জাব এবং বেলুচিস্তানেও কোনও সরকার গঠন করা যাবে না।
৭০টি সংরক্ষিত আসনসহ পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে মোট আসন সংখ্যা ৩৩৬টি। সব মিলিয়ে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য কোনও একটি দলকে জাতীয় পরিষদে কমপক্ষে ১৬৯টি আসন থাকতে হবে।
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব লেজিসলেটিভ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সির (পিআইএলডিএটি) সভাপতি আহমেদ বিলাল মেহবুব বলেছেন, পিএমএল-এন বা পিপিপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জোট গঠন না করে স্পষ্টতই পিটিআই সরকার গঠনের মতো অবস্থানে নেই। কারণ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করার মতো প্রয়োজনীয়সংখ্যক আসন তারা পায়নি।
সংরক্ষিত আসনের হিসাব আপাতত বাদ দিলে পাকিস্তানে সরকার গঠন করার জন্য কোনও দলকে ন্যূনতম ১৩৪টি আসনে জয়লাভ করতে হবে। কিন্তু দেশটির নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত যে ২৫৬টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে কোনও দলই এককভাবে এতো বিপুলসংখ্যক আসন পায়নি।
পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার তিনদিনের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জানাতে হবে, তারা কোনও দলে যোগ দেবেন নাকি স্বতন্ত্র হিসাবেই থাকবেন। এমন অবস্থায় পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন পরবর্তী তিন দিনের সময়ের মধ্যে পিটিআইতে আবারও যোগ দিতে চাইলে কী হবে? আহমেদ বিলাল মেহবুব বলেছেন, এটা সম্ভব। তবে মেহবুব ব্যাখ্যা করেছেন, এটি তাদের জন্য বেশ দীর্ঘ একটি পথ হবে। কারণ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে দলে যোগ দিতে চান তাদের অবশ্যই একটি দলীয় প্রতীক থাকতে হবে, আর এটি বাধ্যতামূলক।
তিনি বলেন, তারা (স্বতন্ত্র প্রার্থীরা) আবার পিটিআইতে যোগ দিতে চাইলে পিটিআইকে আন্তঃদলীয় নির্বাচন করতে হবে এবং তাদের প্রতীক বা অন্য কোনও প্রতীক ফিরে পেতে হবে। আর এটি হলে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সংরক্ষিত আসনও পাবে পিটিআই। তিনি আরও বলেছেন, ২০১৭ সালের ইসিপি বিধির ৯৪ বিধিতে দলীয় প্রতীক থাকার শর্তটি সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্ররা এমডব্লিউএমের মতো অন্য নিবন্ধিত দলগুলোতে যোগ দিতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মেহবুব বলেন, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্ররা এমডব্লিউএম বা অন্য যে কোনও দলে যোগ দিতে পারেন।
তিনি বলেন, যদি তারা সেটি করেন তাহলে তারা সেই দলের শৃঙ্খলা মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা যদি এমডব্লিউএম বা অন্য কোনও দলে যোগ দেয়, তাহলে তারা জাতীয় পরিষদে তাদের মোট আসন সংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত আসনও পেতে পারেন। তেমনটি হলে মোটামুটিভাবে তারা ২৫ থেকে ২৭ আসন পেতে পারেন।
মেহবুব বলেন, এমডব্লিউএম-এ যোগদানের পর সংরক্ষিত আসন পেতে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীদের ইসিপিতে হলফনামা জমা দিতে হবে যে তারা এমডব্লিউএম বা অন্য কোনও দলে যোগ দিচ্ছেন। পরবর্তীতে এমডব্লিউএম বা তারা যে দলে যোগদান করবেন তার প্রধানকে ইসিপিকে লিখিতভাবে জানাতে হবে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের গ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন, ইসিপি ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এটি হতে পারে। এ ছাড়া এমডব্লিউএম সবচেয়ে বেশি আসন পেলে সরকার গঠন করতে পারবে কি না জানতে চাইলে মেহবুব আবারও ইতিবাচক জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘‘একটি সরকার গঠন বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার জন্য একটি দলকে জাতীয় পরিষদে কমপক্ষে ১৬৯টি আসন থাকতে হবে।’’