দেশে অপরিশোধিত লবণের উৎপাদন বেড়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) হিসাবে, চলতি মৌসুমে ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯০ টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে দুই লাখ আট হাজার টন বেশি। তবে, এই বাড়তি উৎপাদনের সুফল মিলছে না। চলতি মৌসুমে মাঠপর্যায়ে প্রতি কেজি লবণ বিক্রি হয়েছে সাত টাকা দরে। অথচ ভোক্তাপর্য়ায়ে মাঝামাঝি মানের লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়।
দেশের মুদি দোকান ও সুপার শপগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোক্তাপর্য়ায়ে এখন ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণ কেজিপ্রতি ৪২ টাকা, মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণ ২৫-৩০ টাকা ও সাধারণ লবণ ১৫-২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরের এস এস খালেদ রোড এলাকার গ্রোসারি শপ জান্নাত স্টোরের স্বত্বাধিকারী নুরুল আবছার বলেন, বাজারে থাকা প্রচলিত ব্রান্ডের প্রতি কেজি লবণ খুচরায় ৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা কোম্পানির কাছ থেকে ৩৫-৩৭ টাকা দরে কিনতে হয়।
লবণ শিল্প উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান ও বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে (২০২৩-২৪) দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার টন। মৌসুমের শেষ দিন (গত ২৫ মে) পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯০ টন, যা গত ৬৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং গত বছরের তুলনায় দুই লাখ আট হাজার টন বেশি। গত (২০২২-২৩) মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৩৩ হাজার টন।
কৃষক ও বিসিকের তথ্যমতে, সম্প্রতি শেষ হওয়া মৌসুমে মাঠপর্য়ায়ে মণপ্রতি (৪০ কেজি) অপরিশোধিত লবণ বিক্রি হয়েছে ২৮০-৩০০ টাকায়, যা বর্তমানে ৩৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। সেই হিসাবে, মাঠপর্যায়ে প্রতিকেজি লবণ বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আট দশমিক ৭৫ টাকার মধ্যে।
চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকার ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান লাল মিয়া সল্টের স্বত্বাধিকারীর আসাদ আহমদ বলেন, কৃষকের কাছ থেকে অপরিশোধিত লবণ কিনে এনে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে তা প্রতি বস্তা (৮০ কেজি) ৮৫০ টাকায় বিক্রি করছে, যার কেজি প্রতি দাম পড়ে ১০ টাকা। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পরিশোধন শেষে তা আমরা মিল গেটে ৯৭০-৯৮০ টাকা প্রতি বস্তা বিক্রি করছি, যা কেজিতে দাঁড়ায় ১২.২৫ পয়সা। আমাদের থেকে কিনে বিভিন্ন হাত বদলে তা খোলা বাজারে ১৫-২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
একই মাঠ থেকে ও একই দামে সংগ্রহ করা অপরিশোধিত লবণ মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে পরিশোধিন শেষে ভোক্তাপর্য়ায়ে ২৫-৩০ টাকা এবং ভ্যাকুয়াম ইভাপোরেশন পদ্ধতিতে পরিশোধিত লবণ ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মিল মালিকদের অভিযোগ, ক্রয়মূল্যের সঙ্গে পরিশোধন, আয়োডিন যোগ ও অন্যান্য খরচ যোগ করে ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে পরিশোধিত প্রতি কেজি লবণের সর্বোচ্চ বাজার দর হওয়ার কথা ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। কিন্তু দেশে ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে লবণ প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানা রয়েছে ছয়টি কোম্পানির। যে কারণে কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে মনোপলি ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে।
ভ্যাকুয়াম পদ্ধতিতে দেশে লবণ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, এসিআই, কনফিডেন্স, ফ্রেশ, তীর, মোল্লা ও মুসকান। যেসব কোম্পানির বাজারজাত করা প্রতি কেজি লবণ ৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
তবে, এ বিষয়ে এস এ গ্রুপের (মুসকান লবণ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজ্জাদ আরেফিন আলম বলেন, মিলগেটে প্রতি কেজি অপরিশোধিত লবণ ১০ টাকায় কিনলেও পরিশোধন করতে প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ প্রসেস লস হয়। যে কারণে প্রতি কেজি লবণে প্রসেস লস হিসেবে সাত টাকা যোগ হয়। এরপর প্রতি কেজি লবণে চার টাকা ইউটিলিটি ফি (গ্যাস), কেমিক্যাল, মেইনটেইনেন্স, স্টাফের বেতন ও প্যাকেজিং ফি হিসেবে ১২ টাকা যোগ হয়। সব মিলিয়ে প্রতিকেজি লবণ পরিশোধন শেষে বাজারে পৌঁছাতে আমাদের খরচ হয় ২৯ টাকা, যা কোম্পানিভেদে দোকানদারদের কাছে ৩৩-৩৬ টাকায় বিক্রি হয়। ভোক্তাপর্যায়ে এই লবণ ৪০-৪২ টাকায় বিক্রি করে দোকানদাররা।
লবণ চাষিরা জানান, গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ কৃষিজ পণ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও লবণের জন্য আশীর্বাদ। এবারে তাপপ্রবাহ বাড়ায় দেশে লবণ মৌসুমে আবাদযোগ্য জমি এবং কৃষকের সংখ্যা বেড়েছে। বিসিকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর দেশে মোট ৬৬ হাজার ৪২০ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছিল। চলতি বছর যার পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর (বিসিকের নিবন্ধিত)। এ হিসেবে চাষের জমি বেড়েছে দুই হাজার ৮১ একর। এছাড়া, চলতি বছর আবাদযোগ্য জমিতে মোট ৪০ হাজার ৬৯৫ জন কৃষক লবণ চাষ করছেন, যা গত বছরের চেয়ে এক হাজার ২২৮ জন বেশি।
দেশে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজারের সাত উপজেলায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয় মহেশখালী উপজেলায়। তবে, উপজেলার মাতারবাড়িতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে লবণ চাষ সীমিত হয়ে আসায় বিকল্প খুঁজছে বিসিক। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায় ২৫ হাজার একর জমিতে লবণ শিল্পপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিসিকের উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়ন না হলেও দ্বিতীয় উপজেলা হিসেবে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ব্যক্তি উদ্যোগে লবণ চাষ শুরু হয়েছে। অবশ্য চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেও লবণ উৎপাদন হয়।
এদিকে, দেশে ভোগ্য লবণের পাশাপাশি টেক্সটাইল ও শিল্পখাতে লবণের চাহিদা প্রতি বছরই বাড়ছে। এর আগে, দেশীয় উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার অসঙ্গতির কারণে আমদানি নির্ভরতা থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে দেশে লবণ আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।