ফুয়াদ খন্দকার : জামালপুরের মাদারগঞ্জে সমবায় সমিতির নামে গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে উধাও প্রায় ২ শত প্রতিষ্ঠান। টাকা ফেরত পেতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ ও মানববন্ধন করেও ফল পাচ্ছেন না। ঘুরে ঘুরে দিশেহারা প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহক।
শুধুমাত্র উপজেলা সমবায় সমিতির রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তোলা হয়েছে সমবায় সমিতি। নামে সমবায় সমিতি হলেও এসব সমিতির ব্যানারে পরিচালনা করা হয় ব্যাংকিং কার্যক্রম। ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে সমবায় সমিতিগুলো প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা। শুরুর দিকে গ্রাহককে কিছু মুনাফা দিলেও বর্তমানে সমবায় সমিতির লোকজন টাকা নিয়ে গাঁ-ঢাকা দিয়েছে। ফলে সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা এসব সমিতির গ্রাহকেরা। সত্তুর উর্দ্ধ জমশেদ মিয়ার এক পা নেই। শারিরিক ভাবে অক্ষম জমশেদ মিয়ার শেষ সম্বল শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া ৫ শতক জমি। অর্থ উপার্জনের পথ না থাকায় সেই জমি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা আমানত রাখেন শতদল বহুমুখী সমিতিতে। ভেবেছিলেন লাভের টাকা দিয়ে তার জীবন কোনভাবে কেটে যাবে। শুরুরদিকে সমিতি থেকে কিছু লাভের টাকা পেলেও কিছুদিন যেতেই বাধেঁ বিপত্তি। শারীরিকভাবে অক্ষম জমশেদ মিয়া প্রতিদিন হামাগুড়ি দিয়ে সিড়ি বেয়ে সমিতিতে আসলেও সমিতির লোকজন টাকা দিতে টালবাহানা শুরু করে। বর্তমানে সমিতির অফিসে তালা ঝুলতে দেখে একরাশ হতাশা নিয়ে অজানা বিপদের শঙ্কায় এখন জমশেদ মিয়া। শুধু জমশেদ মিয়াই নয়, আশি উর্দ্ধ আনোয়ারা বেগম, সুশান্ত চন্দ্র ঘোষ, নুরজাহানের গল্পটা কমবেশি একই রকম।
উচ্চ মুনাফার লোভে পড়ে ভিক্ষুক থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত চাকুরীজীবি, গৃহীনি, প্রবাসী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার অন্তত ৫০ হাজার গ্রাহক এসব সমিতিতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা আমাতন জমা রাখেন। এর মাঝে আল-আকাবা আর শতদল বহুমুখী সমিতির নামেই রয়েছে অন্তত ২০ হাজার গ্রাহকের কয়েক হাজার কোটি টাকার আমানত।
সরেজিমন ঘুরে দেখা যায়, মাদারগঞ্জ শহরের বিভিন্ন আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন নামে বহুমুখী সমবায় সমিতি। এক ভবনেই পাওয়া যায় অন্তত ১৫টি সমিতির কার্যালয়। এসব সমিতিতে একেক জন গ্রাহক সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত রেখেছেন। প্রবাসী এবং অবসরপ্রাপ্ত চাকুরীজীবিরা তাদের সারাজীবনের কষ্টার্জিত অর্থের পুরোটাই সমিতিতে জমা রেখেছেন, কেউবা আবার খেয়ে-না খেয়ে, জমি, গরু-ছাগল বিক্রি থেকে শুরু করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এসব সমিতিতে টাকা জমা রেখেছেন। বর্তমানে প্রায় সবগুলো সমিতির কার্যালয়ে তালা ঝুলছে, আর গ্রাহকরা লভ্যাংশ তো দূরের কথা জমানো আমানত কিভাবে ফিরে পাবে তার আশায় প্রতিদিন সমিতির কার্যালয়ের সামনে এসে ভীড় করছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, আমানতের টাকা ফেরত চাইলে সমিতির লোকজন বার বার তারিখ দিয়ে ঘুড়াচ্ছে তাদের। বর্তমানে সমিতির অফিস বন্ধ থাকায় মুঠোফোনে তাদের সাথে যোগাযোগ করলে টাকার পরিবর্তে তাদের কাছ থেকে জমি নিতে বলছে, কিন্তু সেই জমির বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা শতাংশ হলেও তারা সেই জমির মূল্য ধরছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। এই দামে জমি নিতে না চাইলে টাকা দিতে পারবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে। সমিতির মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নিতে পারছেনা ভুক্তভোগীরা। সম্প্রতি জামালপুর ডিবি পুলিশ মাদারগঞ্জে অভিযান চালিয়ে শতদল এবং নবদ্বীপ নামে দুই বহুমুখী সমবায় সমিতির ৬ কর্মচারিকে গ্রেফতার করা হলেও মালিক পক্ষের লোকজন এখনো ধরাছোয়ার বাহিরে রয়েছে।
ডিবি পুলিশের অভিযানে আটক শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতির ম্যানেজার দাবি করেন, তাদের ৫ হাজার গ্রাহকের ২শ’ ৪৬ কোটি টাকার মধ্যে ৪২ কোটি টাকা ইতিমধ্যে তারা ফেরত দিয়েছেন। তাদের টাকা জমির মধ্যে লগ্নি করা আছে, জমি বিক্রয় স্বাপেক্ষে তারা ছোট গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিচ্ছেন এবং বড় গ্রাহকের জমির বিনিময়ে টাকা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করছেন।
মাদারগঞ্জ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির সভাপতি এবং রূপসী বাংলা সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান রায়হান রহমতুল্লাহ রিমু জানান, অবৈধভাবে বিপুল পরিমান টাকা লেনদেন হয়েছে। নিয়ম না থাকলেও সবাই যেভাবে টাকা লেনদেন করেছে, আমরাও সেভাবে করেছি। তবে টাকা নিয়ে সমিতির অন্য পরিচালকরা ঝামেলা করছে বুঝতে পেরে তিনি কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি এবং রূপসী বাংলা দুই প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক মাস আগে পদত্যাগ করেছেন বলে দাবি করেন।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো: আব্দুল হান্নান জানান, সমবায় আইনে ব্যাংকিং কার্যক্রম করা সম্পূর্ণ নিষেধ। সমবায় সমিতিগুলো আমাদের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে গোপনে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। আর যারা টাকা রেখেছে তারা সমবায়িনা, তারা লোভে পড়ে টাকা রেখেছে। আমরা অডিট করতে গেলে এসব কার্যক্রম আমাদের কাছে গোপন রাখা হতো। কেউ সমবায় সমিতিতে টাকা রাখলে এটা আমাদের দায়-দায়িত্ব না। তিনি আরও বলেন, সমিতির নিবন্ধন দেয়া কোন দোষের কিছুনা, তবে আমাদের কেউ এই কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো: শফিউর রহমান জানান, সমবায় সমিতিতে যারা টাকা রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপরও আমরা সরেজমিন তদন্ত করে দেখবো কেন এতোগুলো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে এবং তারা বিধি মেনে আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে কিনা।