ছোট্ট একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে ঠাকুরগাঁও বড়মাঠের শহীদ মিনারের দক্ষিণ পাশে মুখরোচক খাবারের পসরা নিয়ে বসেছেন আঠারো বছর বয়সী এক তরুণ। ভ্যানগাড়ির চারপাশে রঙিন পেপারে বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে বিভিন্ন খাবারের মূল্য তালিকা। তিনিও মনের আনন্দে ক্রেতাদের মাঝে খাবার বিতরণ করছেন। কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই বলে ওঠেন তার নাম নাসির উদ্দীন পিন্টু। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করছেন। পাশাপাশি চায়ের দোকান। দিনের মধ্যভাগে চা বিক্রি করে যা উপার্জন হয় তা দিয়েই লেখাপড়ার ও বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবার খরচ বহন করেন।
পিন্টুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হলো, মানুষ শুধু মুখেই বলে, কোনো কাজকেই ছোট করে দেখা ঠিক নয়। কিন্তু কেউ কেউ তা করে দেখায়। এই করে দেখানো মানুষদের একজন নাসির উদ্দীন পিন্টু।
পিন্টুর বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে। বাবা আবুল হোসেন দিনমুজুরের কাজ করেন, আর মা নাজমা বেগম বাড়িতেই থাকেন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে পিন্টু ছোট। বোনের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান পিন্টু কোনোমতে এসএসসি পাশ করেছেন স্থানীয় এক হাইস্কুল থেকে। অভাবের সংসারে মাঝেমধ্যে বাবার সঙ্গে কাজে বের হন। খেয়ে-না খেয়ে দিন পার করতেন তিন সদস্যের এই পরিবারটি।
ম্যাট্রিক পরিক্ষায় ভালো ফলাফল করায় মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে গ্রাম থেকে শহরে পারিজমান পিন্টু। ওঠেন পৌরশহরের গোয়ালপাড়া এলাকার একটি মেসে। ভর্তি হন শহরের একটি কলেজে। গত বছর এইচএসসি পরিক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল করেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করছেন। কিন্তু পরিবার থেকে লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন তা পিন্টুর বাবা।
অভাব-অনটনের কারণে একবার ভেবেছিলেন, পড়াশোনা ছেড়ে দেবেন। আবার ভাবলেন—না। যেভাবেই হোক টিকে থাকতে হবে। শেষ করতে হবে পড়াশোনা। সিদ্ধান্ত নেন চা ও ডালপুরি বিক্রি করে লেখাপড়ার খরচ জোগাবেন। সেইসঙ্গে পরিবারকেও সাহায্য করবেন। বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় চায়ের দোকান দিয়েই জীবন বদলানোর স্বপ্ন দেখা শুরু পিন্টুর।
ধার-দেনা করে একটি ভ্যানগাড়ি ও দোকানের কিছু সরঞ্জাম ক্রয় করে যাত্রা শুরু করে তার ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান। দোকানের নাম দেন পিন্টু ফুড কর্নার। প্রথম দিন তাকে দেখে বন্ধু, পরিচিতজনরা অবাক হয়েছিলেন। নানাজন নানা কথা বলেছিলেন। চা বিক্রি না করে কারও সহায়তা নেওয়ারও পরামর্শ দিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সাহায্য চাওয়ার চেয়ে কাজটাকেই তিনি বেশি গুরুত্ব হিসেবে নিলেন। পড়াশোনার খরচ জোগাতে প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভ্যানে করে ডালপুরি, বরা ও চা বিক্রি করে। ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান থেকে যা উপার্জন হয় তা দিয়েই চলে পিন্টু ও তার পরিবার। তার চায়ের দোকানের আরেক সঙ্গী ঝড়ু মিয়া। এই বৃদ্ধই তাকে বিকেলে থেকে রাত পর্যন্ত নানা কাজে সাহায্য করেন। বিনিময়ে পিন্টু ঝড়ু মিয়াকে প্রতিদিন ২০০/৩০০ টাকা সম্মানী দেন। চা বিক্রি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নেওয়ার সাহস দেখিয়ে সবার প্রশংসায় ভাসছেন শিক্ষার্থী পিন্টু।
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রাফিদ বলেন, পিন্টু আমাদের সঙ্গে প্রাইভেট পড়তো। সে চায়ের দোকান থেকে উপার্জনের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করছে। আমরা তার এ কাজকে শ্রদ্ধা করি।
আরেক শিক্ষার্থী শিমুল বলেন, পিন্টুর বিষয়টি সমাজের জন্য ইতিবাচক। যারা চান লেখাপড়া শিখে চাকরি না পেলে নিজে কিছু করবেন তাদের জন্য পিন্টু উদাহরণ।
তরুণ উদ্যোক্তা ও পিন্টু ফুড কর্নারের মালিক নাসির উদ্দীন পিন্টু বলেন, আমি গরিব ঘরের সন্তান। আমার বাবা একজন দিনমজুর। পরিবারের পক্ষ থেকে আমার লেখাপড়ার খরচ চালানো খুবই কষ্টের। তাই আমার মনে হলো লেখাপড়ার পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও শহরে থেকে কিছু একটা করা উচিত বা করা যায়। সে লক্ষে আমার পড়ালেখার পাশাপাশি এই ছোট্ট একটি উদ্যোগ। বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দোকান করে যা আয় হয় সেটার একটা অংশ আমার লেখাপড়ার খরচের জন্য রাখি, আর আরেকটা অংশ আমার মা-বাবার কাছে পাঠাই। চায়ের দোকান দিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।