মেলান্দহে অতিদরিদ্রদের সাড়ে ৮ কোটি টাকা কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের পকেটে!

আসমাউল আসিফ : জামালপুরের মেলান্দহে গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে না অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত কর্মসৃজন প্রকল্প। প্রতি বছরই যে রাস্তাগুলোর সংস্কার ও উন্নয়নে দুই দফায় বরাদ্দ দেয়া হয় সেসব রাস্তায় গত ৮ থেকে ১০ বছরেও কোন উন্নয়ন কাজ হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। শ্রমিকদের নামে ভূয়া তালিকা তৈরি ও সীম ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কাজ না করে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ নেই বলে দাবী করে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানান অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি-ইজিপিপি গ্রহণ করা হয়। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ম ও ২য় পর্যায়ে রাস্তা নির্মান, পুন:নির্মান, সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ বাবদ ৫ হাজার ৭৬৮ জন শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ হয় ৮ কোটি ৪২ লাখ ১২ হাজার ৮শ টাকা। ১ম পর্যায়ে ৪০ দিন ও ২য় পর্যায়ে ৩৩ দিন করে শ্রমিকরা দৈনিক ৪শ টাকা মজুরির ভিত্তিতে কাজ করার কথা থাকলেও বাস্তবে শ্রমিকদের পরিবর্তে বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু রাস্তায় আংশিক কাজ করা হলেও বেশিরভাগ রাস্তায় কোন কাজই হয়নি। ইজিপিপি প্রকল্পের ২য় পর্যায়ে মেলান্দহ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ৬৩টি রাস্তা অন্তর্ভূক্ত করা হয়, যার মধ্যে চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়নের ৪টি গ্রামীণ রাস্তা নির্মানের জন্য অন্তর্ভূক্ত করা হয়। রাস্তাগুলো হলো- চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়নের বেতমারি হতে স্থানীয় হোসেনের বাড়ি পর্যন্ত একটি, দ্বিতীয়টি ঘোড়ামারা খাল হতে কালাই হাড়ি তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত, তৃতীয় রাস্তাটি হলো কালাই হাড়ি থেকে বেতমারি তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত আর চতুর্থটি কালাই হাড়ি বিল থেকে স্থানীয় হাসেনের বাড়ি পর্যন্ত। এসব রাস্তা দিয়ে বেতমারি, চরপলিশা, শিহুরি গ্রামের ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়নে ১ম পর্যায়ে ৪০ দিনের কাজ শেষ হয়েছে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারী আর ২য় পর্যায়ে ৩৩ দিনের কাজ শেষ হয়েছে গত ২ জুন। এই ইউনিয়নে ৬শ ২ জন শ্রমিক উপকারভোগী হওয়ার কথা থাকলেও এসব এলাকায় রাস্তার কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কর্মী বা শ্রমিকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, গত ছয় মাস আগে কালাই হাড়ি বিলের কাঁচা রাস্তাটি শ্রমিকের পরিবর্তে এস্কোভেটার (ভেকু) মেশিন দিয়ে মাটি কেটে নির্মান করা হয়। অর্থাৎ ১ম পর্যায়ের প্রকল্পের আওতায় রাস্তাটি নির্মিত হয়েছে নিয়মবহির্ভূতভাবে আর ২য় পর্যায়ের কাজের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও নতুন করে কোন কাজ করা হয়নি। এস্কোভেটার (ভেকু) মেশিন ব্যবহার করায় স্বল্প খরচে রাস্তা নির্মিত হয়েছে, এতে স্থানীয় শ্রমিকদের বঞ্চিত করার পাশাপাশি অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ নিজেদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের নামে শ্রমিকদের ভূয়া তালিকা তৈরি করে। এরপর তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সীম উত্তোলন করে তা নিজেদের কাছে গচ্ছিত রেখে পরবর্তীতে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা বেতমারি দক্ষিণপাড়া গ্রামের কৃষক হাসান আলী শেখ (৬০) জানান, গত ছয় মাস আগে ভেকু মেশিন দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত কোন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি। শিহুরি গ্রামের ওয়াজিদ (৫৫) বলেন, পাশের কৃষি জমি থেকে মেশিন দিয়ে মাটি তুলে রাস্তা নির্মান করা হয়েছে। এতে রাস্তার পাশে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। গর্তে পানি জমে থাকায় চাষাবাদ না হওয়ায় কৃষি জমি নষ্ট হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন কৃষকরা। একই এলাকার আজাহার (৬০) বলেন, বৃষ্টির পানিতে রাস্তার মাটি পাশের গর্তে গিয়ে পড়ছে, এতে রাস্তায় অনেক ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। নতুন রাস্তার এমন বেহাল দশার কারণে পরিবহন সংকটে কৃষি জমিতে উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলা ও বাজারে নিয়ে যেতেও বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। পাশাপাশি যানবাহন চলাচল করতে না পারায় পায়ে হেটেই যাতায়াত করছে আশেপাশের গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ।
শুধু চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়ন নয় উপজেলার অন্যান্য সব ইউনিয়নের চিত্র কমবেশী একই। এসব এলাকার রাস্তায় চলাচলকারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন গত ৮ থেকে ১০ বছরেও রাস্তার কোন সংস্কার বা উন্নয়ন কাজ হয়নি। রাস্তার বেহাল অবস্থার জন্য খুব বেশী যানবাহন চলাচল করে না। এতে অসুস্থ কাউকে হাসপাতালে নিতে ও ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার জন্য চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বর্ষায় এই ভোগান্তির মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ।
নাগরিক অধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী বলেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য অতিদরিদ্রদেরকে কর্মের আওতায় এনে তাদের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেয়া। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইউপি চেয়ারম্যানদের যোগশাজসে প্রকল্পের পুরো টাকাই আত্মসাৎ করে আসছেন। এতে করে সরকারের টাকা ব্যয় হলেও প্রকল্পের উদ্দেশ্য ভেস্তে গিয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন অতিদরিদ্ররা।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, কর্মহীন সময়ে গ্রামের মানুষের জন্য এই কর্মসৃজন প্রকল্প পরিচালিত হয়, যাতে গ্রামীন রাস্তাঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীন অর্থনীতি শক্তিশালী হতে পারে। আমি বিভিন্ন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেছি আমার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়েছে। এস্কোভেটার মেশিন ব্যবহার বা শ্রমিকদের তালিকায় কোন অসংগতির বিষয়ে অভিযোগ পাইনি। শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধিত সীমে টাকা পরিশোধ করা হয়। অন্য কারো সীমে টাকা প্রদানের কোন সুযোগ নেই। তবে যদি অনিয়ম থাকে বা কারো কাছে যদি সীম গচ্ছিত থাকে সে ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।