খাদেমুল ইসলাম : ৬ বছর আগেও ছিলেন মোবাইল ও কম্পিউটার মিস্ত্রি। অভাব-অনটন ছিল সংসারের নিত্যদিনের সঙ্গী। অনলাইন জুয়ার বরকতে কম সময়ের মধ্যে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। গড়েছেন অঢেল সম্পদ, রয়েছে একাধিক সুপার শপ, জমি-জমাসহ বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বাড়ি। ব্যবহার করেন দামি গাড়ি। নিয়মিত ঘুরতে যান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। জনশ্রুতি রয়েছে তার বেশিরভাগ উপার্জন অবৈধ পথে। তবে কাগজপত্রে বৈধ হিসেবেই দেখাচ্ছেন তিনি।
আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া ব্যক্তিটির নাম মাহমুদুল হাসান। তবে ক্যাসিনো মাসুম হিসেবে এক নামে চিনে জামালপুরের সকলে। তিনি জেলার মেলান্দহ উপজেলার আদিপৈত গ্রামের আনছারুল আলমের ছেলে। কিন্তু অনলাইন জুয়ার কাণ্ডারি হওয়ায় বাবার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই মাসুমের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০২ সালে মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মাসুম। এরপর মেলান্দহ বাজারের চিশতীয়া মার্কেটে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখেন। সেই সময় খুব অভাব-অনটন ছিল তাদের পরিবারে।
২০১৬ সালের শেষের দিকে রাজশাহীতে গিয়ে একটি দোকানে কিছুদিন চাকরি করেন। এরপর মেলান্দহের জাহানারা লতিফ মহিলা কলেজে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে অস্থায়ী চাকরি করেন দুই বছর। এ সময় মেলান্দহের জিন্নাহ মার্কেটের নিচতলায় ও জামালপুর শহরের শহীদ হারুন সড়কে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান দেন মাসুম।
২০১৮ সালের দিকে শুরু করেন জুয়ার কারবার। তার দোকানেই শুরু করেন অনলাইন জুয়ার ব্যবসা। আর জুয়াড়িদের বাজি ধরা টাকা থেকে নিতেন ২০ পার্সেন্ট।
জিন্নাহ মার্কেটের ‘আড্ডা ক্যাফে’ নামক দোকানে আইপিএল, বিপিএল ও বিগ ব্যাশ খেলার অনলাইন জুয়ায় যুক্ত হতো মেলান্দহের কিশোর, তরুণ ও যুবকেরা। বাদ যেতেন না মধ্যবয়সীরাও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিন্নাহ মার্কেটের এক দোকানদার বলেন, ‘এই মার্কেটের নিচতলায় মাসুম যখন জুয়ার আসর শুরু করলো, তখন রাত দিন জুয়া চলতো। দোকানে অনেক লোকজন থাকতো। বিষয়টি আমাদের ভালো লাগতো না। জুয়া নিয়ে কানাকানি শুরু হলে মাসুম তার দোকানটি ভবনের ছাদে নিয়ে যান। আর সেখানেই নিরিবিলি চালাতেন রমরমা অনলাইন জুয়া।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাসুমের সঙ্গে জুয়া খেলায় অংশগ্রহণকারী একজন বলেন-‘মাসুম ভাইয়ের স্ত্রী যদি বাসা থেকে বাজার পর্যন্ত রিকশা দিয়ে আসতো, তাহলে সেই রিকশা ভাড়ার বিশ টাকা দেওয়ার মতো অবস্থাও মাঝে মধ্যে মাসুম ভাইয়ের ছিল না। কিন্তু ক্রিকেট লীগের জুয়া থেকে তিনি টাকা ইনকাম করা শুরু করার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ওই ব্যক্তি বলেন, আইটি বিষয়ে মাসুম ভাই অনেক এক্সপার্ট ছিল। তিনি নিজেই বাংলায় জুয়ার একটি অ্যাপস বানিয়েছিলেন। অ্যাপসটির নাম ছিল ঢাকা সেল। সেই সময়ে বাংলায় জুয়ার অ্যাপস মানে বিশাল ব্যাপার। আমরা সেটিতে খেলতাম। ২০১৯ সালে অনেক টাকা খরচ করে দেশের বাইরে অথবা দেশের ভেতরে কোথাও থেকে অ্যাপসটি আপডেট করে আনেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার অনলাইন জুয়ার সফলতা। বর্তমানে বেশ কয়েকটি অ্যাপসের সুপার এজেন্ট বলে জানান তিনি।
২০১৯ সালেই জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ক্যাসিনো মাসুমের নাম। নিজের অ্যাপসের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি জুয়ার অ্যাপসের সুপার এজেন্ট হয়ে যান ক্যাসিনো মাসুম। আয় করেন কোটি কোটি টাকা। ২০১৯ সালে সারাদেশে ক্যাসিনো কাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হতে থাকলে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে র্যাব-১৪ এর হাতে চারজনসহ মাসুমও আটক হন। তবে সেই মামলায় খালাস পেয়ে যান মাসুমসহ বাকিরা। এরপর একবার র্যাব-১ এর হাতে ধরা পড়লে সেখান থেকেও বের হয়ে যান আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে।
ওই সময় মাসুমের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন-‘মাসুমের মোবাইলে এমন একটি অ্যাপস আছে যেটিতে এক ক্লিক করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোবাইলের সব ডাটা রিমুভ হয়ে যাবে। মাসুম যতবার বিপদে পড়েছে বা কোনো বিপদের সংকেত পেয়েছে, তখনই তার মোবাইলের সব ডাটা রিমুভ করে ফেলেছে।’
মাসুমের যত সম্পদ- কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও খুব স্বাভাবিক চলাফেরা করেন মাসুম। সম্প্রতি তার আয়ের কিছু অংশ দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়- মাসুম ২০২০ সালে মেলান্দহের ব্র্যাক মোড়ে দুই বিঘা জমি কিনেছেন। যেখানে রয়েছে তার মিশাল এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। এছাড়া সেখানে সুইমিংপুল ও মাশমির জিমসহ অনেক কিছু রয়েছে। জামালপুর-মেলান্দহ সড়কের শিমুলতলা এলাকায় বড় একটি জমি রয়েছে মাসুমের। এর কিছু অংশে রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস। বাকি অংশে মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন তিনি। যার দাম কোটি টাকার উপরে। এছাড়াও জামালপুর শহরের পশ্চিম নয়াপাড়া এলাকায় একজন চিকিৎসকের বাসা কেনার কথা রয়েছে তার। যেটির দামও কোটি টাকার উপরে। ঢাকার বসুন্ধরাতে রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে মাশমির বাজার নামে সুপার শপ দিয়েছিলেন মাসুম। বর্তমানে সেই ব্যবসাটি বাদ দিয়েছেন তিনি। তবে জামালপুর শহরের শহীদ হারুন সড়ক ও মেলান্দহ পৌর এলাকার জিন্নাহ মার্কেটে মাশমির বাজার নামে দুটি সুপার শপ রয়েছে তার। চলাফেরা করেন ৪০ লাখ টাকা দামের গাড়িতে। মেলান্দহের ফুলছিন্না এলাকায় কিনেছেন ৯৫ শতাংশ জমি। জিন্নাহ মার্কেটের পেছনে হাজী কলোনিতে মাসুমের বাবার নামে থাকা দুতলা বাড়িটির নির্মাণ কাজ করেছেন খুবই বিলাসবহুলভাবে।
তবে মাসুমের মতো সৌভাগ্যবান নয় বেশিরভাগ মানুষ। এই অনলাইন জুয়ার কারণে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন জামালপুর শহরের নয়াপাড়ার বাসিন্দা ময়না আকন্দ (ছদ্মনাম)।
এই প্রতিবেদককে ময়না আকন্দ বলেন—‘এই অনলাইন জুয়ার লোভে পড়ে আমি আমার সব হারিয়েছি। এখন আমাকে একটি কোম্পানির চাকরি করতে হয়।
অনলাইন জুয়ায় মজে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। অনলাইন জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের ২৭ মার্চ প্রাণ হারাতে হয় উজ্জলকে। জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার বালিয়া ব্রিজপাড়া এলাকায় বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার ৫ দিন পর পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয় উজ্জলের মরদেহ।
নিহত উজ্জলের বাবা উশর আলী বলেন- ‘অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেনকে কেন্দ্র করে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই। তবে এই অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের ধরতে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো কথা বলতে রাজি হননি স্থানীয় প্রশাসনের কেউ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুম ঢাকা টাইমসকে বলেন- ‘আমি ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ ১০টি দেশ ভ্রমণ করেছি, ৪০ লাখ টাকা দামের একটি গাড়ি আছে আমার এবং উল্লিখিত সম্পত্তি ও ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানও আছে। সবই সত্যি। তবে এসব আমার বৈধ আয়ে গড়া। ক্যাসিনো বা জুয়ার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছু মানুষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
দুইবার র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে জানিয়ে মাসুম বলেন, আমাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমি দুটি মামলা থেকেই খালাস পেয়েছি।
জামালপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন—‘মাসুমের মতো জামালপুরে এমন অনেকে আছে। যারা অনলাইন জুয়ার উপর ভর করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আবার অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। দুদকের উচিত হবে এসব ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা। তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। তাহলে অনেকেই বেঁচে যাবে এই অনলাইন জুয়ার থাবা থেকে।’
জামালপুরের পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো ডাউন করতে বিটিসিএলকে অনুরোধ করা হবে। এছাড়াও নির্দিষ্ট কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’