রাহুল গান্ধী কেন জয়শঙ্করকে নিশানা করছেন?

ইতিহাস বলে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনও বড় যুদ্ধ বা সংঘাতের পর দিল্লিতে সরকার ও প্রধান বিরোধীদল মোটের ওপর এক সুরেই কথা বলেছে এবং একটা জাতীয় ঐক্যের বার্তা দিয়েছে। কিন্তু গত ৭ মে থেকে টানা চারদিন ধরে চলা ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পর বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে প্রবল মতবিরোধ ও তিক্ততা ক্রমশ সামনে চলে আসছে।

বিশেষ করে ভারতের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী যেভাবে এই ইস্যুতে লাগাতার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে আক্রমণের নিশানা করছেন, তাতেই বোঝা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের মধ্যে মোটেই সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না।

বিষয়টা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রাহুল গান্ধী প্রকাশ্যে এক্স বার্তায় ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে আগাম অভিযানের তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হয়েছিল বলেই তারা ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করতে পেরেছে! সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কিংবা দল হিসেবে বিজেপিও জয়শঙ্করের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভারতে ইতোমধ্যে তীব্র বিতর্ক দানা বেঁধেছে।

তার আক্রমণের লক্ষ্য যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি এমপি এস জয়শঙ্কর, সেটাও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন কোনও রাখঢাক না করেই। এদিকে নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের অপারেশন সিঁদুরের তাৎপর্য ও ভারতের অবস্থান তুলে ধরতে বিশ্বের নানা প্রান্তে যে প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে; তাতে শাসক জোটের পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোরও বহু নেতা ঠাঁই পেয়েছেন।

আমেরিকায় যে দলটি পাঠানো হচ্ছে, তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আবার কংগ্রেসের হাই-প্রোফাইল এমপি শশী থারুর; যার সঙ্গে নিজের দলের সম্পর্কই বেশ শীতল এবং তিনি সংঘর্ষের সময় মোদি সরকারের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন।

সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি আপাতত বহাল থাকলেও ভারতের অভ্যন্তরে শাসক ও বিরোধীদলের মধ্যে উত্তেজনার পারদ কিন্তু চড়তে শুরু করেছে।

• রাহুল বনাম জয়শঙ্কর বিতর্কের সূত্রপাত যেভাবে

গত শনিবার (১৭ মে) বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের একটি ছোট্ট ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করেন, যাবতীয় বিরোধের উৎপত্তি সেই ভিডিও থেকেই। ১৭ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি ছিল সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন প্রতিনিধির সামনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্য।

সেখানে জয়শঙ্করকে বলতে শোনা যায়, অভিযানের শুরুতেই আমরা পাকিস্তানকে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলাম যে, আমরা জঙ্গী অবকাঠামোগুলোতে আঘাত হানছি, কিন্তু সামরিক স্থাপনায় কোনও আক্রমণ করছি না।

সুতরাং তাদের মিলিটারির সামনে এই অপশনটা ছিল যে তারা এটা থেকে সরে দাঁড়াবে এবং অভিযানে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু তারা সেই উচিত পরামর্শে কান দেয়নি, বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভিডিওটি শেয়ার করে রাহুল গান্ধী তার পোস্টে লেখেন, আমাদের আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই তা পাকিস্তানকে জানানো তো একটা অপরাধ! পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, ভারত সরকার ঠিক সেই কাজটাই করেছে।

এরপরই তিনি দু’টি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, কে এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছিল? এবং এর পরিণতিতে আমাদের বিমানবাহিনী কতটি যুদ্ধবিমান খুইয়েছে? প্রসঙ্গত, সংঘর্ষের প্রথম দিনেই পাকিস্তান দাবি করেছিল তারা অত্যাধুনিক রাফাল-সহ ভারতের মোট পাঁচটি ফাইটার জেট ভূপাতিত করেছে।

এর জবাবে এখন পর্যন্ত ভারত পরিষ্কার করে জানায়নি তাদের কতটি বিমান কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু একটি ব্রিফিংয়ে ভারতের বিমানবাহিনী মন্তব্য করেছিল, ক্ষয়ক্ষতি যে কোনও কমব্যাট সিচুয়েশন বা যুদ্ধ পরিস্থিতির অংশ।

• জয়শঙ্করের সমর্থনে সরকারের বিবৃতি

এরপর জয়শঙ্করের নিজের মন্ত্রণালয়ই তার বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করে একটি বিবৃতি দেয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই বিবৃতিতে বলে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন আমরা শুরুতেই পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলাম, যেটা স্পষ্টতই অপারেশন সিঁদুর শুরু হওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে। এটাকেই অভিযান শুরুর আগে ঘটেছে বলে মিথ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিকৃতভাবে এই তথ্য পেশ করার তীব্র নিন্দা জানাই।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাইয়ের একটি বক্তব্যকেও এখানে টেনে আনা হয়। অপারেশন সিঁদুরের একটি ব্রিফিংয়ে জেনারেল ঘাই জানিয়েছিলেন, অপারেশন সিঁদুর শুরু হওয়ার ঠিক পরই পাকিস্তানের ডিজিএমওকে ফোন করে ভারত জানাতে চেয়েছিল, সন্ত্রাসের পীঠস্থানে আঘাত হানতে কেন তারা বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয় এবং পাকিস্তান জানিয়ে দেয় তারা পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ভারতের ডিজিএমও এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উভয় বক্তব্যই সাযুজ্যপূর্ণ। এটাই ছিল সরকারের দাবি। ভারতের প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর ফ্যাক্ট চেক শাখাও দাবি করে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হচ্ছে।

তারা জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কখনও বলেননি যে অপারেশন সিঁদুর শুরু হওয়ার আগেই পাকিস্তানকে জানানো হয়েছিল। তাকে এখানে মিসকোট করা হচ্ছে। তিনি কখনও এরকম কোনও মন্তব্য করেননি।

• দ্বিতীয় রাউন্ডেও আবার যুযুধান কংগ্রেস-বিজেপি

সরকারের আক্রমণে তিনি যে বিচলিত নন, সেটা বোঝাতে সোমবার দুপুরে দেশটির বিরোধীনেতা রাহুল গান্ধী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই বিতর্কিত ভিডিওটি আবার রিপোস্ট করে প্রশ্ন তোলেন, জয়শঙ্কর নীরব কেন?

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নীরবতাকে দেশের জন্য মারাত্মক বলে দাবি করে তিনি লেখেন, সুতরাং আমি আবার প্রশ্ন করব, পাকিস্তান যে আগেভাগেই জানত, তার জন্য কতটি এয়ারক্র্যাফট আমরা খুইয়েছি? এটা নিছক একটা গাফিলতি নয়। এটা একটা অপরাধ। আর দেশবাসী হিসেবে আমাদের সত্যিটা জানার অধিকার আছে!

ইতোমধ্যে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চরবৃত্তি করারও অভিযোগ আনা হয়। কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা ও দলীয় মুখপাত্র পবন খেড়া সেখানে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পর্কটা কী, যে তারা আগেভাগেই অভিযান সম্পর্কে জেনে গেল!

‘‘এটা তো কোনও কূটনীতি নয়, এটা স্রেফ চরবৃত্তি। সবাই শুনেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেছেন, এখন সেটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, মন্তব্য করেন তিনি।

কংগ্রেসের এই লাগাতার আক্রমণের মুখে বিজেপির এখন যুক্তি, বিরোধী দলনেতা যা বলছেন তার সঙ্গে পাকিস্তানের কথার মিল পাওয়া যাচ্ছে। বিজেপির মুখপাত্র শেহজাদ পুনাওয়ালা রাহুল গান্ধীর প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানি টিভি চ্যানেল জিও নিউজের একটি ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে লেখেন, রাহুল গান্ধীর বিচিত্র মিথ্যা এখন পাকিস্তানের মিডিয়াতে জায়গা করে নিচ্ছে!

‘‘তারা দু’জনই একই ভাষায় কথা বলছেন… নিছক সমাপতন বলে ধরে নিতে হবে? সংঘর্ষ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্ক যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এটাই তার প্রমাণ। বিবিসি বাংলা।