রৌমারী সংবাদদাতা : নানা সংকটের মুখে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প। লোকসান, প্রয়োজনীয় পুজির অভাব, দফায় দফায় শ্কাঁরমিক ও কাচাঁমালের দাম বৃদ্ধিসহ সরকারি সুযোগ সুবিধার অভাবে হারিয়ে যাওয়ার পথে এ তাঁত শিল্প। যে টুকু আছে, তাও বন্ধের পথে। মালিক ও কারিগরদের দুর্দীনে পেশা বদলিয়েছেন অনেক।
সেকালে এ এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙ্গতো তাঁতের খটখট শব্দে। সারাদিন বাহারি রঙ্গের লুঙ্গি, চাদর শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন কারিগররা। দিন শেষে তাঁতের তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি চাদর, গামছা বিক্রয় করতে গাইড সাজিয়ে এলাকার বিভিন্ন হাটে হাটে যেতো তাঁত মালিকরা। অন্যদিকে তৈরি কাপড় বাইরের ব্যবসায়ীরা পাইকারি কিনতে আসতো।
জানা গেছে, রৌমারী উপজেলার চরশৌলমারীর ফুলকারচর, চর কাজাইকাটা, মিয়ারচর, গেন্দার আলগা বাঘমারাসহ সেকালে তাঁত শিল্পের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭ হাজার। বর্তমানে স্বচল রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ শতটি। অচল হয়েছে ৫ হাজারটি।
সরেজমিনে চর কাজাইকাটা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও গেন্দার আলগা গ্রামের মেম্বার শমসের আলীর তাঁত কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, দুই চালা টিনের তৈরি ঘরের মধ্যে ২ টি তাঁতকল। কারিগররা ভোর থেকেই খটখট শব্দে মনিপুরী শাড়ি তৈরি করছে। ২ জন ৫০ অর্ধো বৃদ্ধা মহিলা চরকার সাহায্যে সুতা গুটিয়ে দিচ্ছে। আরেকজন মাটির পাত্রের মধ্যে এরারুট বার্লির আঠা দিয়ে সুতা ও কাপড় ভিজিয়ে শুকাতে দিচ্ছে।
এ সময় কথা হয় তাঁত কারিগর আনোয়ারের সাথে, তিনি বলেন, বাপ দাদার পেশা আমরা ধরে রেখেছি। বর্তমানে এ পেশায় আছি। গত ৩ দশক আগেও ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২ শত টাকায় এক বেল্ট সুতা পাওয়া যেতো। বর্তমানে ১ বেল্ট সুতা কিনতে হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার টাকায়। এছাড়াও বেরেছে রংসহ অন্যান্য কাঁচা মালের দামও। কিন্তু সেই অনুপাতে শাড়ি চাদরের দাম বাড়েনি। যার ফলে সারাদিনের হারভাঙ্গা খাটুনির পরও আয় হয় মাত্র ৩ থেকে ৪ শত টাকা। বাপ দাদার পেশা ধার দেন, ঋনপাতি করে, জীবন বাঁচার দায়ে কোন রকমে এই পেশা ধরে আছি।
গেন্দার আলগা গ্রামের মেম্বার শমসের আলী জানান, বাপ দাদার পেশা, লোকসান হলেও এ পেশা ছাড়তে পারি না। আমাদের এ এলাকায় ৪৫ থেকে ৫০ বছর আগে থেকে তাঁত শিল্প শুরু হয়। এই তাঁত শিল্পের উপর নির্ভর করে খেয়ে পড়ে ভালোই চলতো কারিগরদের সংসার। আমরাও ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাঁতের তৈরি পন্য তৈরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই চলতে পেরেছি। এরপর থেকে রং ও সুতার দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে লোকসানে গুনতে হয়। প্রয়োজনীয় পুজির অভাব, দফায় দফায় কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিসহ সরকারি সুযোগ সুবিধার অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁতকল। ফলে অনেকেই এ পেশা বদলিয়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। ৫ বছর আগেও এ এলাকায় প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার তাঁতকল ছিল। কিন্তু বর্তমানে টিকে আছে মাত্র আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজারটি।
তাঁত কারিগর চর শৌলমারী গ্রামের নাসরিন আকতার সুমি বলেন, আগে যে কাজ করেছি, তা দিয়ে সংসার ভালো ভাবে চলতো। শ্রমিক ও সুতাসহ অন্যান্য মালামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ হয় না, সংসারও ভালো চলে না। সরকারি ভাবেও কোন সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় না। তাই এ পেশা বাদদিয়ে বাড়ির মালিক কে নিয়ে অন্য পেশায় কাজ করে জীবন ধারনের চিন্তা করছি। এভাবে চলতে থাকলে এ ব্যবসা খুব দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার উজ্জ্বল কুমার সরদার বলেন, এখানকার তাঁতশিল্পের বিষয় আমার তেমন জানা নেই। তবে তাঁত শিল্প পরিদর্শনে গিয়ে তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে, এবং সমস্যা গুলি যেনে সরকারি ভাবে সুযোগ সুবিধা করে দেয়ার ব্যবস্হা গ্রহণ করা হবে।
রৌমারীতে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁত শিল্প দুর্দীন মালিক ও শ্রমিকদের
