শেরপুর সংবাদদাতা : নৃ-জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় কেবল পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেই হবে না। নিজ ভাষার পাঠ্যপুস্তকগুলো যাতে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে, যাতে সঠিকভাবে পাঠদান করা হয়, তাহলেই কেবল নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষার সুফল পাওয়া যাবে।
কিন্তু শেরপুর জেলার গারো অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে গারো ভাষায় পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর মতো শিক্ষকের অভাবে শিশুর শিক্ষা ও বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এজন্য নৃ-জনগোষ্ঠী বসবাসকারি এলাকাগুলোতে নিজ ভাষাভাষি শিক্ষকের অভাব দূর করতে হবে। যথাযথ শিক্ষক নিয়োগের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রীবরদী টিডাব্লুউএর সভাপতি কবি প্রাঞ্জল এম. সাংমা বলেন, এটা ঠিক যে বর্তমান সরকারের দুরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী নৃ-জনগোষ্ঠীর নিজেদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রি-প্রাইমারি পর্যায়ে গারোসহ কয়েকটি নৃ-জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে পাঠদানও চলছে। কিন্তু যেসব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে, সেসব পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ায় পাঠদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে নৃ-জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদানের উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সাংবাদিক রেজাউল করিম বকুল বলেন, স্থানীয় বাস্তবতায় দেখা যায়, শেরপুর জেলায় গারো, কোচ, হাজং, বর্মন, বানাই, ডালু ও হদিসহ ৭টি ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর বসবাস।
তাদের মধ্যে গারো, কোচ, হাজং এবং ডালু জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে কোনো ধরনের বর্ণমালা সংরক্ষিত না হওয়ায় মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। তবে গারো জনগোষ্ঠী রোমান হরফে গারো ভাষার বর্ণমালা চালু করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু গারো অধ্যুষিত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় শিক্ষকের অভাবে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। সকল জাতিসত্ত্বার মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। আইপি ফেলো সুমন্ত বর্মন বলেন, দেশে বসবাসকারী সকল নৃ-জাতিস্বত্ত্বার ভাষা রক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। যেসব নৃ-জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রচলিত আছে কিন্তু নিজস্ব বর্ণমালা নেই, তাদের বর্ণমালা উদ্ধার ও লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সকল নৃ-জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। নৃ-জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় মাতৃভাষায় পাঠদানের উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। কোচ নেতা মিঠুন কোচ বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমতল ও পাহাড় মিলিয়ে প্রায় ৪৫টিরও অধিক নৃ-জনগোষ্ঠীর বসবাস। প্রতিটি নৃ-জাতিসত্ত্বার নিজস্ব ভাষা থাকলেও তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। আমাদের কোচ ভাষাটিও লিখিত রূপ না থাকায় বর্ণমালা হারিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হচ্ছে কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ভাষা আন্দোলনের চেতনা তখনই সার্থক হবে যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারবে, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে নিজস্ব ভাষার বিষয়টি যুক্ত। মাতৃভাষা মানুষের আত্মবিকাশের পথ সম্প্রসারিত করে। জনউদ্যোগ আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার। যেকোনো মূল্যে সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যে চেতনায় আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথা বলি, একই চেতনায় বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষার কথাও বলতে হবে।