সংস্কার-নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবি করেছে জামায়াত, কারও পদত্যাগ নয়

দুটি বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। একটি হচ্ছে সংস্কারের রোডম্যাপ আর একটি হচ্ছে নির্বাচনী রোডম্যাপ। ড. ইউনূস জামায়াতের উত্থাপিত এ দুই দাবি ইতিবাচক হিসেবেই দেখেছেন বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে শনিবার (২৪ মে) রাতে বৈঠক করার পর গণমাধ্যমকে এ কথা বলেন তিনি।

এর আগে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছিল। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে কোনো উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করা হয়নি।

বিএনপি সরকারের নিরপেক্ষতার জন্য তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে—এ বিষয়টি জামায়াত কীভাবে দেখে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পদত্যাগ চাইলো বিএনপি আর ফতোয়া দেবে জামায়াতে ইসলামী? এটা কি মানায়? যারা তিনজনের পদত্যাগ চেয়েছেন তারাই সে ব্যাখ্যা দেবেন। আমরা কারো কোনো পদত্যাগ চাইনি।’

জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, ‘বাংলাদেশে কয়েকদিন ধরে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত পরশুদিন বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠক থেকে প্রধান উপদেষ্টা তিনি একটি ম্যাসেজ জাতিকে দিতে চেয়েছিলেন। যদিও সেটা দেননি। কিন্তু তার ওই বক্তব্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। যার কারণে সমাজে একটি অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা, আতঙ্ক দেখা দেয়। আমরা সেদিনই ওই কথাগুলোকে নোটিশে নিয়েছি। একই সময়ে একজন রাজনৈতিক দলের নেতা তার জনপ্রতিনিধিত্বের একটি দাবি নিয়ে একটি অবস্থান নিয়েছিলেন।’

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে আরেকদল অবস্থান নিয়েছিল। এসব কিছু প্রধান উপদেষ্টার জন্য কিছুটা কষ্টের, কিছুটা বিরক্তির ছিল। যার কারণে তিনি তার দায়িত্বের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করবেন এমন একটি অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সেটা অফিসিয়ালি সামনে আসেনি। এ ব্যাপারে আমাদের মতো সবাই বিচলিত ছিলেন। কারণ দেশ আমাদের সবার। দেশ ভালো থাকলে আমরা সবাই ভালো থাকবো।’

তিনি বলেন, ‘২৪ জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশে একটি পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের এখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সরকারে তারা, তাদের পরিচয় হচ্ছে যে তারা কোনো পার্টিতে বিলং করবেন না। এটা হওয়া উচিত। কিন্তু এখানেও কিছু ব্যতিক্রম ঘটেছে। এটা সমাজকে মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবর্তন বা বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবী দাবি ছিল অর্থবহ কিছু সংস্কার করা লাগবে, এবং যারা অপরাধী তাদের বিচার করতে হবে। এই সংস্কার এবং বিচারের মধ্য দিয়েই একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন হবে এবং ওই নির্বাচনে সমতল মাঠ থাকবে। নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবেন তাদেরকে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হবে না। এখানে পেশিশক্তি ও কালো টাকার প্রভাব চলবে না।’

তিনি বলেন, ‘গত সাড়ে ১৫ বছর দেশের মানুষ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি, ভোটের অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এবার তারা নিঃসংকোচে নিজেরাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায় এবং সেই সুযোগ পাবে নিশ্চিতভাবে। এটিই হচ্ছে জনগণের দাবি।’

জামায়াত আমির বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই কয়েকবার বলেছেন, নির্বাচন তিনি দিতে চান এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট তিনি কোনো রোডম্যাপ দেননি। কোনো মাস, সপ্তাহ তিনি ঘোষণা করেননি। এটাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের দাবি, নির্বাচনের রোডম্যাপের ব্যাপারে আছে। আমাদেরও কিছু রিকমেন্ডেশন ছিল।’

‘আমরা তার প্রতি সম্মান রেখেই বলেছিলাম, দায়িত্ব আমরা তাকে সবাই মিলে দিয়েছি, তিনি চেয়ে নেননি এবং তিনি কোনো দলের পক্ষ থেকে নির্বাচিত কোনো দায়িত্বশীল নেতা নন। বরং তিনি জনগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই জায়গায় একটি গুরুভার গ্রহণ করেছেন। তাকে আমরা তার সম্মান বজায় রেখে দেশের স্বার্থটা দেখবেন বলে আমরা সবসময় বলে আসছি।’

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা আজকেও এ ব্যাপারে কথা বলেছি। আমরা বলেছি, দুটি বিষয়ে স্পষ্ট করা দরকার। একটি নির্বাচন কবে হবে সেটা আপনি সময় দিয়েছেন কিন্তু এর ভেতরেই জনগণের কোনো বড় ধরনের ভোগান্তি না হয়ে একটি কমফোর্টেবল টাইমে একটি নির্বাচন হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। দ্বিতীয়টি হলো নির্বাচনের আগে অবশ্যই সংস্কার এবং দৃশ্যমান বিচার প্রক্রিয়া জনগণের সামনে আসতে হবে। সংস্কার শেষ না করে যদি নির্বাচন হয় তাহলে সেই নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘আবার সব সংস্কারই এই সরকারের পক্ষে করা সম্ভব হবে না। মাত্র পাঁচটা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তারা হাত দিয়েছেন। এতটুকু নিষ্পত্তি হওয়া উচিত সন্তোষজনকভাবে। এর পাশাপাশি এখানে জুলাই ঘোষণাপত্র ব্যাপার স্যাপার আছে যা জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত।’

তিনি বলেন, ‘অনেক দলের দাবির মধ্যেও কিছু ভিন্নতা আছে, এটা থাকবে। দলগুলোর মতেরও ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে, আমার মতো আমি প্রকাশ করবো, আরেকজনের মতের প্রতি আমি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবো। আমি কারো মতকে তুচ্ছ জ্ঞান করবো না, উপহাস করবো না এবং কাউকে অপমানিত করবো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সীমা আমরা মেনে চলতে পারিনি। আমাদের এটা পারা উচিত। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যে ভিন্ন মত প্রকাশ করার সুযোগ, অবকাশ আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি সমস্ত দলই দেশকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা দায়িত্ববোধ ও জায়গা থেকে আমরা যদি সব দল এগিয়ে আসি এবং আমরা যদি সংস্কারের প্রক্রিয়াকে অর্থবহ সহযোগিতা করি তাহলে একটি অর্থবহ সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা একটি অর্থবহ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবো ইনশাল্লাহ। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি।’

তিনি বলেন, ‘সমাজে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল এটাকে কেন্দ্র করে, আপাত দৃষ্টিতে তা কিছুটা কমেছে। আমরা এর স্থায়ী নিষ্পত্তি চাই। আমরা মনে করি দুটো রোডম্যাপ ঘোষণা করলে শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একটি হচ্ছে সংস্কারের রোডম্যাপ আরেকটা হচ্ছে নির্বাচনী রোডম্যাপ। এ দুটোই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দেশকে ভালোবাসার জায়গা থেকে, বিবেক ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে যেটা উত্তম মনে করেছি সেটাই বলেছি এবং সে ব্যাপারে কাজ করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ন্যায় ও সত্যের পথে আমরা অবিচল থাকবো এবং দেশের স্বার্থকে আমরা বড় করে দেখবো এটাই আমাদের অঙ্গীকার।’

এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।