আসমাউল আসিফ : জন্মগতভাবে দুটি হাত নেই জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের দিনমজুর দম্পতি জিন্নাহ মিয়া-জোসনা বেগমের তৃতীয় সন্তান সিয়াম মিয়ার। শৈশবে ভাই বোন ও বন্ধুদের সাথে স্কুলে যাতায়াত করতে করতে আগ্রহ জন্মায় লেখাপড়ার প্রতি। শিক্ষকদের সহায়তায় দুই হাত বিহীন সিয়াম পা দিয়ে লেখা শিখতে থাকে। এরপর পা দিয়ে লিখেই পাঠ এগিয়ে নিতে থাকে সে। উপজেলার উদনাপাড়া ব্র্যাক শিশু নিকেতন স্কুল থেকে ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র স্কুল এন্ড কলেজে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় সিয়াম। ২০২১ সালে অষ্টম শ্রেণীতে জেএসসি পরীক্ষায়ও কৃত্তিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয় সে, এতে করে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়ে তার। এবার একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় কারো কোন সহায়তা ছাড়া অংশ নেয় সিয়াম। মনের অদম্য শক্তি, স্বপ্ন পূরণের তীব্র আকাঙ্খা, দারিদ্রতা ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে পা দিয়ে লিখে অসামান্য কৃত্তিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয় সিয়াম, মানবিক বিভাগ থেকে অর্জন করে জিপিএ ৩.৮৩।
অদম্য মেধাবী শারীরিক প্রতিবন্ধী সিয়াম মিয়ার উজ্জল ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন পূরণের সারথি হতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দৈনিক খবরের কাগজের পাঠক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বন্ধুজন’। চিলড্রেন ওয়াচ ফাউন্ডেশন (সিডব্লিওএফ)-এর আর্থিক সহায়তায় ‘অদম্য মেধাবীদের পাশে আছি’ এই মূলমন্ত্র নিয়ে খবরের কাগজ বন্ধুজন-সিডব্লিওএফ ‘অদম্য মেধাবী বৃত্তি ২০২৪’ এর আওতায় সিয়াম মিয়াকে এককালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার রেলস্টেশন এলাকায় সরিষাবাড়ী প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এ উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সরিষাবাড়ী প্রেসক্লাবের সভাপতি সোলায়মান হোসেন হরেকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জামালপুর জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী। এছাড়াও সাংবাদিক এএসএম জুলফিকুর রহমান, জহুরুল ইসলাম ঠান্ডু, মিজানুর রহমান, এম এ রউফ, মোস্তাক আহমেদ মনির, বাদশা ভূইয়া, সরিষাবাড়ী রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সহ অন্যান্যরা বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সিয়াম মিয়া ও তার মা জোসনা বেগম উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বক্তারা বলেন, অদম্য মেধাবী সিয়াম মিয়া কৃতিত্ব অর্জন করে প্রমাণ করেছে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে আর্থিক অনটন, প্রতিবন্ধিতা বা যে কোন বাধা অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব। সিয়াম অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে, তবে সিয়ামের পাশাপাশি তার মত আরও যারা সুবিধা বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন রয়েছে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিত্তবান ব্যাক্তিদের প্রতি আহবান জানান। সিয়ামের উজ্জল ভবিষ্যত প্রত্যাশা করে তাকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য খবরের কাগজ বন্ধুজন-সিডব্লিওএফ’র এর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন বক্তারা। পরে লেখাপড়ায় খবরের কাগজ বন্ধুজন-সিডব্লিওএফ’র সহায়তা হিসেবে অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী, সোলায়মান হোসেন হরেকসহ অন্যান্যরা সিয়াম ও তার মায়ের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন খবরের কাগজের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি আসমাউল আসিফ।
শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে সিয়াম জানায়, জন্ম থেকেই আমার হাত নেই। বাবা-মা আমাকে স্কুলে নিয়ে যেত, শিক্ষকদের সহায়তায় পা দিয়ে লেখা শিখি। পা দিয়ে লিখে আমি এবার এসএসসি পাশ করেছি, আমার স্বপ্ন একজন সরকারি বড় কর্মকর্তা হওয়া। এই প্রথম খবরের কাগজ থেকে বৃত্তি পেয়ে সে খুব খুশি বলে জানায় সিয়াম।
সিয়ামের মা জোসনা বেগম বলেন, অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। অসহায় সন্তানের হাত না থাকলে একমাত্র মা জানে তার ছেলের কি কষ্ট। পা দিয়ে লিখে সে এসএসসি পাশ করেছে, এখন কলেজে ভর্তি হবে এতে আমি খুবই খুশি, আমার অনেক আনন্দ লাগছে। আমার ছেলে সিয়ামের ইচ্ছা বড় হয়ে সে সরকারি চাকরি করবে।
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রাথমিকের মাঝ পথে সিয়ামের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিদ্যালয় থেকে বেতন মওকুফ করলে পুনরায় পড়ালেখা শুরু করে সিয়াম। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট সিয়ামের বিশেষ কৃতিত্ব অর্জনের জন্য পরিবার, স্বজন, প্রতিবেশি ও শিক্ষকরা অনেক খুশি। তবে কলেজে ভর্তিচ্ছুক সিয়ামের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ায় জন্য সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেছেন সকলেই।