দুই বছর পেরিয়ে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ গড়িয়েছে তৃতীয় বছরে। দীর্ঘ এই সময়ে রুশ আগ্রাসন ও ইউক্রেনের পাল্টা হামলায় হয়েছে হাজারও মানুষের প্রাণহানি। ঘর-বাড়ি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখো মানুষ।
তবে সম্প্রতি পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর সহায়তায় টান পড়ায় ইউক্রেন অনেকটা ব্যাকফুটে। এমন অবস্থায় ইউক্রেন জিতবে বলে যুদ্ধের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
একইসঙ্গে ইউক্রেনকে শেষ হতে দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি। রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার পূর্ণ-মাত্রায় আগ্রাসনের পর দুই বছর পূর্তিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধে তার দেশ বিজয়ী হবে। রাজধানী কিয়েভে এক ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘আমরা কেউই আমাদের ইউক্রেনকে শেষ হতে দেব না।’
এদিকে যুদ্ধের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে পশ্চিমা নেতারা সংহতি প্রদর্শনে কিয়েভে গিয়েছিলেন এবং তাদেরকে পাশে নিয়েই জেলেনস্কি এই মন্তব্য করেন।
বিবিসি বলছে, যুদ্ধের দ্বিতীয় বার্ষিকী এমন এক সময়ে সামনে এসেছে যখন নিজের ভূখণ্ড থেকে রাশিয়াকে বিতাড়িত করার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে ইউক্রেন। জেলেনস্কি শনিবার তার বক্তৃতায় বলেন, যে কোনও সাধারণ মানুষ যুদ্ধ শেষ করতে চায় তবে এটি কেবল ইউক্রেনের শর্তেই হতে পারে।
তার ভাষায়, ‘এ কারণে, ‘যুদ্ধের সমাপ্তি’ শব্দের সাথে, আমরা সবসময় ‘আমাদের শর্তে (এটি শেষ হবে বলে)’ যোগ করি। তাই ‘শান্তি’ শব্দটি সর্বদা ‘ন্যায়’-এর সাথে যায়। আমরা এটির জন্যই লড়াই করছি। ইতোমধ্যেই আমরা আমাদের জীবনের ৭৩০ দিন এটির জন্য লড়েছি। এবং আমরা আমাদের জীবনের সেরা দিনে জিতব।’
যুদ্ধের বার্ষিকীতে কিয়েভে জেলেনস্কির সাথে যোগ দিয়েছিলেন ইতালি, বেলজিয়াম এবং কানাডার নেতারা। সেইসাথে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনও সেখানে ছিলেন। যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের স্মরণে তারা একটি দেয়ালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
তবে উপস্থিতির দিক দিয়ে গত বছরের চেয়ে কিছু স্পষ্ট পার্থক্যও এদিন চোখে পড়েছিল। এদিন কিয়েভে কোনও সিনিয়র মার্কিন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না, যেখানে গত বছর যুদ্ধের প্রথম বর্ষপূর্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই উপস্থিত ছিলেন।
জেলেনস্কি অবশ্য গত শুক্রবার মার্কিন আইনপ্রণেতা ও মেজরিটি লিডার চাক শুমারের নেতৃত্বে একদল ডেমোক্র্যাটিক সিনেটরের সাথে দেখা করেন। সেসময় এটিকে তিনি ওয়াশিংটন যে ইউক্রেনকে সমর্থন করেছে এমন ইঙ্গিত বলে আখ্যা দেন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন ডার লিয়েন কিয়েভে উপস্থিত হয়ে সেই ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশংসা করেন যারা আক্রমণের প্রথম দিনগুলোতে দেশকে রক্ষা করেছিল এবং রাশিয়ার আক্রমণ শক্তিকে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে রুশদের প্রত্যাশাকে কার্যত বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আপনারা ইউক্রেনের প্রাণকেন্দ্রে রাশিয়ার আক্রমণ থামাতে পেরেছেন। আপনারা আপনাদের দেশকে বাঁচিয়েছেন, আপনারা পুরো ইউরোপকে বাঁচিয়েছেন।’
এদিকে ইতালি এবং কানাডা জানিয়েছে, তারা কিয়েভের সাথে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর অর্থ ইউক্রেনের ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হওয়ার আশাকে আরও বাড়িয়ে তোলা। পরে কানাডা, ইতালি, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ জি-৭ এর সদস্যরা একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন এবং রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এছাড়া ইউক্রেনের সাথে সংহতি জানিয়ে ইউরোপজুড়ে মিছিলও অনুষ্ঠিত হয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুদ্ধের অবসানের দাবি জানান।
অন্যদিকে শনিবার মস্কোতে সৈন্যদের স্ত্রীদের সংগঠিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অন্তত চারজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। দেশটিতে এই ধরনের বিক্ষোভ বিরল কারণ রাশিয়ায় এখন বিভিন্ন আইন রয়েছে যা ভিন্নমতকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
মূলত রাশিয়ার আক্রমণের এই দ্বিতীয় বার্ষিকী ইউক্রেনের জন্য একটি কঠিন সময়ে এসেছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে দেশটি ঘোষণা করে, তারা আভদিভকা শহর থেকে সৈন্যদের প্রত্যাহার করেছে। এটি গত কয়েক মাসের মধ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জয়গুলোর একটি।
ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের ব্যর্থতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে সামনে আসা সমস্যাগুলোও কিয়েভকে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
তবে লড়াই থেমে নেই, বরাবরের মতো সংঘাত চলছেই। ইউক্রেনের শহরগুলোতে রাশিয়ার সর্বশেষ হামলায় কমপক্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। কিয়েভ বলেছে, শনিবার ভোরে তারা ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং সেই হামলায় রাশিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত কারখানাগুলোর একটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইউক্রেনও অবশ্য গত দুই বছরের এই যুদ্ধে কিছুটা অগ্রগতি লাভ করেছে। যার মধ্যে রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া এবং গুপ্তচর বিমানগুলোকে ভূপাতিত করার মতো ঘটনাও রয়েছে।
আর এতো কিছুর পরও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা (বাস্তবতা থেকে) এখনও অনেক দূরে বলেই মনে হচ্ছে।