অভিষেকের পর থেকে ঠিক কত ম্যাচে বাজে বোলিং করেছেন তানজিম হাসান সাকিব। এমন একটা প্রশ্ন করলে উত্তর দুই ভাবেই দেওয়া সম্ভব। এখন পর্যন্ত আলোচিত এই পেসারের নেই কোন বলার মত সাফল্য। কোনো ফাইফার পাননি। চার উইকেটও না। তবে, অভিষেকের পর থেকে ছয় ওয়ানডেতেই তানজিম দারুণ ধারাবাহিক। উইকেটও পেয়েছেন নিয়মিত। তারচেয়ে বড় কথা, নতুন এই পেসার বাংলাদেশের জন্য লাকি চার্ম।
শরিফুল ইসলাম এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পেস বোলিং লাইনআপের সেরা বোলার, এমনটা বলতেই পারেন আপনি। ২০২০ সালের যুব বিশ্বকাপে শরিফুলের সংগেই বাংলাদেশের বোলিং লাইনআপ সামাল দিয়েছিলেন তানজিম সাকিব। জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকেই লাল-সবুজের জার্সিতেও তিনি দুর্দান্ত। উইকেটের ভার খুব বেশি না হলেও, এখন পর্যন্ত জুনিয়র সাকিবকে রাখা যেতে পারে আস্থার তালিকায়।
ঠিক এই একই সাকিব, খেলার বাইরে বেশ সমালোচিত বলা চলে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিল। তানজিম সাকিবের পারফরম্যান্স নিয়ে সেই যুক্তি খুব একটা চলে না। জাতীয় দলে তার পারফরম্যান্সে অসন্তুষ্টি জানানোর জায়গা নেই বললেই চলে। কিন্তু অন্যান্য কর্মকাণ্ডে তানজিম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন বারবার।
ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চা করে জাতীয় দলের মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বারবারই শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছেন দেশের মানুষের। তানজিম সাকিবও হাঁটতে পারতেন সেই পথে। যদিও তার ফেসবুক পোস্টে আগ্রাসনের পরিমাণই খানিক বেশি। এমনকি দাবি উঠেছিল, তাকে যেন আর কখনোই বাংলাদেশ দলে ঠাঁই না দেওয়া হয়।
সেই সাকিব, এরপর থেকে যখনই সুযোগ পেয়েছেন জাতীয় দলে ত্রাতা হয়েছেন। বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিলেন একেবারে শেষে গিয়ে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটা ছিল সেরা আটে থাকার শেষ সুযোগ। সেই ম্যাচে খরুচে ছিলেন জুনিয়র সাকিব। খরচ করেছেন ৮০ রান। কিন্তু দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নিয়েছেন তিনিই। বাংলাদেশও ম্যাচ জিতে নিজেদের মান বাঁচায় সেবার।
গতকালের ম্যাচের কথাই বলা যাক। পাথুম নিশাঙ্কা এবং আভিস্কা ফার্নান্দো রীতিমতো শাসন করছিলেন বাংলাদেশের বোলারদের। শরিফুল, তাসকিন, তাইজুল সবাই তখন ব্যর্থ। অধিনায়ক শান্তর তূণে শেষ অস্ত্র ছিলেন মিরাজ এবং তানজিম। এদের মধ্যে তানজিমই হলেন ত্রাতা। তিন উইকেট নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন একা হাতে।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুর রহিমের কণ্ঠেও ঝরল সেই তিন উইকেট প্রাপ্তির কথা, ‘সাকিব (তানজিম) পুরো ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। টার্নিং পয়েন্ট সেটিই। তিনটা উইকেট ভালো সময়ে নিয়েছে। পরে তাসকিন, শরীফুলরাও ভালো করেছে।’ ড্রেসিংরুমেও মুশফিক জয়ের আনন্দে বললেন, থ্রি চিয়ার্স ফর শান্ত (সেঞ্চুরি এবং ম্যাচসেরা), সাকিব (৩ উইকেট) এবং মুশি (অর্ধশতক)।’
সেই সাকিবই আবার একইসময়ে ফেসবুকে ভেসেছেন নিন্দার ঝড়ে। পবিত্র রমজান মাসে রোজা না রেখেই মাঠে গিয়েছেন তিনি। পানি খাওয়ার সেই দৃশ্যটা নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে মুশফিকুর রহিমকেও শুনতে হলো এই প্রশ্ন। উত্তরে মুশফিক খানিক হেসে বলেন, ‘আপনারাও অনেক সময় এরকম করে লেখেন। অন্যান্য মানুষও ভিন্ন কোনো ইস্যুতে লিখতে পারে। আমি সবসময় ভালোটা প্রত্যাশা করব, আপনিও সবসময় ভালো লিখবেন ব্যাপারটা এমন না। একেক মানুষ একেকভাবে চিন্তা করতে পারে, দেখতে পারে, বলতে পারে। ওর প্রেক্ষাপট কী সেটা ভিন্ন। আমিও কিন্তু ওরকম জানি না।’
পেসারদের জন্য কঠিন অবস্থার কথাও বলেছেন তিনি, ‘যেটা বললেন ওর (সাকিব) অবস্থাটা কী, সেটা কিন্তু ভিন্ন। কারণ, স্বাভাবিক আজকে যেরকম গরম ছিল, ওর জন্য একটু কঠিন ছিল, ক্র্যাম্প হচ্ছিল। পেস বোলারদের জন্য এটা আরও অনেক কঠিন। আপনি যদি খেয়াল করেন, আজকে প্রায় দু-তিনজনের ক্র্যাম্প হচ্ছিল। এটা মানুষের যার যার ব্যক্তিগত মন্তব্য।’
সবমিলিয়ে তানজিম সাকিবের খেলা ৬ ম্যাচের ৪টিতেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। এই ৪ ইনিংসে তিনি পেয়েছেন ১১ উইকেট। বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য তাকে লাকি চার্ম ভাবা যেতেই পারে।
এসব বিতর্কের বাইরে মাঠের ক্রিকেটের আলাপে তানজিম দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন ত্রাতা। ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শূন্য রানে। পরে তিলক ভার্মাকেও টিকতে দেননি। তার গড়ে দেওয়া ভিতের ওপর বাকি কাজ শেষ করেছে বোলিং ইউনিট। সেই ম্যাচটাও জিতেছিল বাংলাদেশ।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে নিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে কোনো উইকেট পাননি। সেই ম্যাচ অবশ্য ভেসে যায় বৃষ্টিতে। এরপর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নেলসনের ম্যাচেও ছিলেন না আলোচনায়। পরের ম্যাচেই ১৪ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন। বাংলাদেশও জয় পেয়েছে। আর গতকাল চট্টগ্রামে তিনিই ছিলেন বোলিং ইউনিটের নায়ক। সবমিলিয়ে তানজিম সাকিবের খেলা ৬ ম্যাচের ৪টিতেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। এই ৪ ইনিংসে তিনি পেয়েছেন ১১ উইকেট। বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য তাকে লাকি চার্ম ভাবা যেতেই পারে।
তানজিম সাকিবকে এবার কোন ভূমিকায় মূল্যায়ন করবে বাংলাদেশের সমর্থকরা, সেটা নিতান্তই তাদের নিজস্ব। তবে ক্রিকেটের মাঠে তানজিমের ভূমিকাটা যেন পার্শ্বঅভিনেতার মতোই। ম্যাচ জেতানোর উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন বারবার। তবে তার মূল্যায়ন হয়নি। বরং মাঠের বাইরের নিন্দায় ঢাকা পড়েছে জুনিয়র সাকিবের বড় হওয়ার অধ্যায়টা।