ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষকের কয়েক মণ বেগুন

রমজানের আগেও বাজারে বেগুনসহ সব সবজির দাম ছিল কয়েক গুণ বেশি। সেখানে রমজান মাসে বেগুনসহ সব ধরনের সবজির দাম কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। গত কয়েক বছরের চিত্র পাল্টে এবার রমজান মাসে হঠাৎ বেগুনের দামসহ কমেছে সব ধরনের সবজির।

যে বেগুনের দাম কয়েকদিন আগেও ৫০ থেকে ৬০ টাকা ছিল, ঝিনাইদহের হাটে এখন সেই বেগুন পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা পর্যন্ত। গোল বেগুনের পাইকারি কেজি ১০ থেকে ১৫ টাকা আর খুচরা দাম ২০ টাকা। রোববার (২৩ মার্চ) ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী, সাগান্না ও সাধুহাটি ইউনিয়নের বিভিন্ন সবজির মাঠ এবং জেলার ডাকবাংলা পাইকারি ও খুচরা বাজারে এমন চিত্র দেখা গেছে।

জানা যায়, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার মাঠে বেগুন চাষ হয়েছে ৩২০ হেক্টর জমিতে। টমেটো ১৭০ হেক্টর, ফুলকপি ১৯৫ হেক্টর, বাঁধাকপি ২২০ হেক্টর, মুলা ২২৫ হেক্টর, লাউ ২৫০ হেক্টর, পালংশাক ১৫০ হেক্টর, লালশাক ১২৫ হেক্টরসহ বিভিন্ন সবজি চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২ হাজার ৮৭৫ মেট্রিক টন।

আরও জানা যায়, প্রতি বছর রমজান মাস এলেই বেগুনসহ অন্যান্য সব সবজির দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে রমজানে ইফতারির বিশেষ আয়োজনে থাকে বেগুনি, যার কারণে বেগুনের চাহিদা বাড়ে কয়েক গুণ। সেই সঙ্গে অন্য সবজির দামও বেশ চড়া। বিগত বছরগুলোতে বেগুনের বাজার দর বেশি থাকায় রমজানে বেগুনি নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনাও হতে দেখা যায়। ভালো মুনাফা পেতে রমজানকে ঘিরে বেগুন চাষাবাদ করেন অনেক চাষি। আর এতেই ঘটেছে বিপত্তি। প্রথম রমজানের আগে পাইকারি বাজারে বেগুন ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও রমজান শুরু থেকে দরপতন ঘটে। বেগুনের বাজার এমন পর্যায়ে গেছে যে বাজারে ৫ টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। ফলে ক্ষেত থেকে বেগুন সংগ্রহ করার শ্রমিকের খরচই উঠছে না চাষিদের।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষিরা বেগুন চাষ করছে। আবার অনেক বেগুন ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু জমিতে প্রচুর পরিমাণে বেগুন থাকলেও কৃষকেরা বেগুন তুলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় সেগুলো ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। 

রোববার বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকের থেকে সবজির হাতবদল হলেই ১০ টাকার বেগুন কেজিতে ১০-১৫ টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকেরা নতুন গোল বেগুন ১০ টাকা, কাটা বেগুন ১২-১৫ টাকা কেজি দরে পাইকারিতে বিক্রি করছে। অথচ খুচরা ব্যবসায়ীরা সেই বেগুন ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি করছে। তিন দিনের ব্যবধানে বাজারের কেজিতে ৫-১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন বাজার পেয়ে সাধারণ ক্রেতারা খুশি হলেও কৃষকেরা এমন দাম পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। উৎপাদনের তুলনাই খরচের পরিমাণ বেশি হওয়াও লোকসানের মুখে বেগুন চাষিরা।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি না থাকলেও এখন কিছুটা কমেছে। কয়েকটি সবজি ১০ টাকা কমে এখন ৪০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। সবজির মধ্যে মুলার কেজি ৩০ টাকা, শসা ৫০-৬০ টাকা, কচুর লতি ৩০ টাকা, বেগুন ১০ থেকে ৩০ টাকা কেজি, কাঁচা কলা প্রতি কেজি ১০-১৫ টাকা, লাউ প্রতি পিস ১০ থেকে ১৫ টাকা, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ৪০ টাকা, শিম প্রতি কেজি ১৫ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ২০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া কেজি ৩০ টাকা, টমেটো ২০-৩০ টাকা, গাজর ৩০ টাকা এবং কাঁচামরিচ মানভেদে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রমজানে বাজারে এখন সবচেয়ে দামি সবজির তালিকায় রয়েছে সজনে, বরবটি ও করলা। এগুলো সজনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। পালংশাক ৩-৫ টাকা আটি, লাল শাক ৫ টাকা, ডাটা শাক ৫ টাকা দরে বিক্রয় হচ্ছে।

কৃষক দাউত হোসেন বলেন, আমরা বেগুনের চাষ করছি এর আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তখন লাভ হয়েছে। কিন্তু ৪ টাকা থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হলে কৃষকের সার কেনার টাকাও থাকে না। আমাদের দেশে তো অন্য দেশের মতো সিস্টেম নেই। অন্যান্য দেশে সবজির বাজার দাম কম হোক বা বেশি হোক কৃষকের মাঠ থেকে কোম্পানি কিনে নিয়ে বাইরে বিক্রি করে। এজন্য বেগুন বা সবজি চাষে কখনো কখনো অনেক লাভ হয়, আবার অনেক লোকসানও হয়। বাজারে বেগুনের দাম বেশি হলে এক বিঘা জমিতে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বেগুন বিক্রি করা যায়। লাভও হয় খরচের চেয়ে কয়েকগুণ। এখন দাম কম যার কারণে কৃষকের বেগুন চাষে অনেক লস হবে। 

সদর উপজেলার সাগান্না গ্রামের কৃষক নূর-ইসলাম বলেন, এ বছর সবজির আবাদ খুব বেশি হয়নি। তবুও বাজারে চাহিদা নেই। চাহিদা কম থাকায় দাম কমে গেছে। বাজারে বেগুন নিয়ে গেলে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। আগে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা আসত, এখন আর আসছে না। অথচ রমজানের আগেও প্রতি কেজি বেগুন ৪০/৫০ টাকা পাইকারি বিক্রি হয়েছে। বর্তমান বাজারে ৮-১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এমন দাম থাকলে কৃষকের অনেক ক্ষতি হবে।

সদর উপজেলার ডাকবাংলা বাজারের খুচরা সবজি ব্যবসায়ী জামাল, মোশারফ ও শাহিন জানান, রমজান মাসে সবজির চাহিদা কম থাকে। যার কারণে রমজান মাসে বেগুনসহ সব ধরনের সবজির দাম কম। রোববার হাটের তুলনায় গত ২১ মার্চ বাজারে সবজির যে দাম ছিল তার থেকে কিছুটা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে পাইকারি বেগুনের দাম ছিল ৫ টাকা কেজি, লাউ ৭-১০ পিস, করলা ৪০ টাকা কেজি, পটল ৩৫ টাকা কেজি, টমেটো ২৫ টাকা কেজি। তিন দিনের ব্যবধানে সবজির বাজার কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। বাজারের সবগুলো সবজি সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। তবে বর্তমানে সার ও কীটনাশক খরচ যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই তুলনায় বাজারের এই অবস্থায় থাকলে কৃষকদের উৎপাদনের তুলনায় খরচ অনেক বেশি। তবে রমজান মাস গেলে হয়তো সবজির বাজার কিছুটা বাড়তে পারে।

উপজেলার বকশীপুর গ্রামের বেগুন চাষি সনজের আলী বলেন, ছোট থেকেই কৃষি কাজ করি। মাঠে আড়াই বিঘা বেগুন, বরবটি দেড় বিঘা, খিরা ৫ কাঠা ও ১৩ কাঠায় মরিচ ক্ষেত রয়েছে। এছাড়া পুরানো বেগুন ক্ষেত রয়েছে দেড় বিঘা। বাজারে বেগুন ৪-৫ টাকা কেজি, ভালো বেগুন হলে ১০ টাকা দরে বিক্রয় হচ্ছে। রমজানের আগে যে বেগুন ১২শ থেকে ২ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। সেই বেগুন এখন দুই’শ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে না। ক্ষেতেই ৩০-৪০ মণ বেগুন ক্ষেতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিক্রি করতে পারছি না।

বাজারে পাইকারি বেগুন ৫-১০ টাকা কেজি, পটল ৪০ টাকা কেজি, ডাটা ৫ টাকা আটি, টমেটো ১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে এক মণ বেগুন উৎপাদন করতে ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে, সেখানে মাত্র ৪শ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে বেগুন চাষে লস হচ্ছে। এর আগে বেগুন ৮শ, ১৫শ এবং ২ হাজার টাকা মণ বিক্রি করতে পেরেছি।

তিনি আরও বলেন, আমি ১ বিঘা জমি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেগুন চাষ করেছি। যেখানে নেট, বাঁশ, তার, সুতা এবং কৃষি শ্রমিক দিয়ে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে এক টাকাও বিক্রি করতে পারিনি। বেগুন চাষ করতে গিয়ে এখন লস হচ্ছে। শুধু আমি নয় আমার মতো অন্য কৃষকেরাও লোকসানে আছে। গরু বিক্রি করে বেগুন চাষ করেছি, ফের গরু বিক্রি করে সার ওষুধ এবং শ্রমিকের টাকা দিতে হবে। এক বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করতে সার, কীটনাশকসহ সব খরচ করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। ১ হাজার টাকা মণ (৪০ কেজি) দরে বেগুন বিক্রি করতে পারলে কৃষকেরা লাভবান হবে। বাজারের অবস্থা এমন হলে আমাদের অনেক ক্ষতি হবে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-এ-নবী বলেন, বেগুন শীতকালীন সবজি। এই বেগুন শীত মৌসুমেই বেশি আবাদ করা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে রমজান মাসে বেগুনের দাম বেশি ছিল। যার ফলে কৃষকেরা রমজান মাসকে টার্গেট করে বেগুনের বেশি আবাদ করেছেন। তাই এ বছর বেগুনের উৎপাদন অনেক বেশি। উৎপাদনের তুলনাই তেমন চাহিদা না থাকায় বেগুনের দাম কমে গেছে। তবে বাজারে অন্যান্য সবজির দাম তেমন কমেনি। কৃষকেরা সবাই যদি একটি সবজিই চাষ করে তাহলে উৎপাদন বেড়ে যাবে এবং চাহিদা কমে যাবে, বাজারে চাহিদা না থাকলে বিক্রি করতে পারবে না ফলে কৃষকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ থাকবে কৃষকেরা যেন সব ধরনের সবজি পরিমাণ মতো চাষ করে। তবে বাজারে বেগুন ছাড়া অন্যান্য সবজির দাম স্বাভাবিক আছে।