মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের হস্তচালিত টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। ফলে, এলাকার মানুষের মধ্যে পানির সংকট এখন চরমে পৌঁছেছে। দীর্ঘ অনাবৃষ্টি, ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা ও পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগামীতে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে।
জেলার গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের আমতৈল, মানিকদিয়া, কেশবনগর, শিমুলতলা, কাথুলি ইউনিয়নের গাঁড়াবাড়িয়া, ধলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় চলতি শুষ্ক মৌসুম শুরু থেকেই সুপেয় পানির সংকট প্রকট হচ্ছে। এসব এলাকায় নিচের দিকে নামছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। দূরদূরান্ত থেকে পানি এনে কোনো রকমে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করছেন গৃহিণীরা। তবে পানি সংকটের কারণে চরম হতাশায় রয়েছেন গ্রামের মানুষ।
জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মাটির নিচে ৫০-৬০ ফুট গভীরে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ওইসব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে গৃহস্থালির কাজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বোরো চাষে পানির সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্রীষ্মকাল শুরু না হতেই এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। অথচ, গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই শেষ ভরসা।
তারা বলেন, বাড়ির টিউবওয়েলে পানি মিলছে না। দুই সপ্তাহ ধরে মোটর চালালেও তাতে পানি উঠছে না। পানি নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে জানান মানিকদিয়া গ্রামের গৃহবধূ শাহানারা। একই অবস্থা তাদের আশপাশেও। অথচ তাদের বাড়ি থেকে দেড়শ গজ দূরে বয়ে চলেছে মাথাভাঙ্গা নদী। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছেন তারা।
গৃহবধূ মমতাজ বেগম বলেন, আগে ২০-৩০ মিনিট মোটর চালালেই বাড়ির ছাদের ট্যাংক পূর্ণ হয়ে যেত। ১৫-২০ দিন ধরে দুই-তিন ঘণ্টা মোটর চালালেও প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। এভাবে নষ্ট হচ্ছে অনেকের বৈদ্যুতিক মোটর।
মানিকদিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমার বাড়ির টিউবওয়েলে প্রায় ১৫/২০ দিন পানি নেই। শুধু আমার বাড়ি নয়, মানিকদিয়া গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই একই অবস্থা। খাবার পানির জন্য এখানে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে।
নাসির উদ্দিন জানান, প্রায় ১৫/২০ দিন আগ থেকে পানি পাচ্ছি না। সকাল ৯টা পর্যন্ত সামান্য পানি পেলেও দুপুরের পর থেকে বিকেল পর্যন্ত একেবারে পানি পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় গ্রামে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির অভাবে পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
সরেজমিনে মানিকদিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, এলাকার কয়েকজন গৃহবধূ ও শিশু জাগ, কলসি ও ঘড়া নিয়ে লাইন ধরে একটি টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
গৃহবধূ জোছনা খাতুন, শাহানাজ খাতুন রোকেয়া বলেন, আমাদের টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। তাই এই টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে এসেছি।
মানিকদিয়া গ্রামের কৃষক সেলিম উদ্দিন বলেন, শুধু হস্তচালিত টিউবওয়েলই নয়, স্যালো মেশিনও (গভীর নলকূপ) পানি কম উঠছে। মাঠে আগে যেখানে এক বিঘা জমি ভেজাতে ২ ঘণ্টা লাগতো, এখন সেই জমি ভেজাতে ৬ ঘণ্টা লাগছে। পাশে মাথাভাঙ্গা নদী আছে। নদীতেও পানি শুকিয়ে গেছে। নদীর মধ্য দিয়ে এখন মোটরসাইকেল চলছে। আমি ১৭/১৮ বছর আগে একবার এমনটি দেখেছিলাম।
ষোলটাকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার পাশা বলেন, ষোলটাকা ইউনিয়নে মোট ৬ হাজার ২১৫টি খানা রয়েছে। এসব খানাতে প্রায় ৬ হাজার টিউবওয়েল রয়েছে। এই ইউনিয়নের ৪/৫ গ্রামে বিশেষ করে চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাস টিউবওয়েলে পানি থাকে না। এই সমস্যাটা প্রায় ৩/৪ বছর আমি দেখছি। আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রশাসক ও গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেবদের অনুরোধ জানাচ্ছি বিষয়টি নজরে নেওয়ার জন্য। ইউনিয়নে যে পরিমাণ বাজেট রয়েছে তা দিয়ে পানির এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
শিক্ষাবিদ ও পরিবেশবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পানির এ সংকট দেখা দিয়েছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। এখনই সচেতন না হলে আগামীতে সমস্যা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
গাংনী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, গাংনী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির স্তর প্রতিবছর ১০ থেকে ১১ ফুট নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও এই এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটেরও বেশি গভীরে।
গাংনী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান কল্লোল বলেন, দীর্ঘ অনাবৃষ্টি, বাড়তি তাপমাত্রা ও সেচ দেওয়ার জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এ ভোগান্তির কারণ বলে মনে করছেন। ভূ-পৃষ্ঠীয় পানি বা সারফেস ওয়াটারের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে আগামীতে এ সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা এই কর্মকর্তার।
তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে হস্তচালিত অনেক টিউবওয়েল।