ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পটুয়াখালীর মহিপুর থানা পুলিশের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খোন্দকার মো. আবুল খায়ের তার শ্বশুরের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছেন। শুধু অবৈধ সম্পদ উপার্জনই নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করাসহ নানা অভিযোগ। মহিপুর থানা পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তার নির্যাতনের শিকার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। নির্যাতিত এসব সাধারণ মানুষের দাবি, এই দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তাকে যেন বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
ওসি খন্দকার মো. আবুল খায়ের মহিপুর থানায় কর্মরত অবস্থায় শ্বশুরের নামে কিনেছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। ওই সম্পত্তিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সময় কোনো অর্থ পরিশোধ না করে প্রতিবেশী হালিম মোল্লা নামের এক জমির মালিককে কারাগারে প্রেরণ করে জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাবেক ওই কর্মকর্তা মহিপুর থানায় কর্মরত অবস্থায় প্রকাশ্যে ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। আর দাবিকৃত অর্থ না দিলে হয়রানি ও মামলা দেওয়ার হুমকি দিতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জমি সংক্রান্ত ভুক্তভোগী হালিম মোল্লা ঢাকা পোস্টকে জানান, দেড় বছর আগেও পটুয়াখালীর পশ্চিম কুয়াকাটা এলাকায় সড়কঘেঁষা ৭ শতাংশ জমির বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন। হঠাৎ ২০২৩ সালের একরাতে তৎকালীন মহিপুর থানার ওসি খন্দকার মো. আবুল খায়ের হালিম মোল্লাকে একটি মামলায় সাক্ষী দেওয়ার জন্য তার ছেলেসহ থানায় নিয়ে যান। পরের দিন সকালে তাদের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেন। সাত দিন জেল খেটে বাড়ি ফিরে দেখেন কোনো টাকা পরিশোধ না করেই তার বাড়ির ওই সম্পত্তির চারপাশে উচ্চ সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে জমি দখলে নিয়েছেন ওসি। পরবর্তীতে সেখানে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করে ওই জমির মালিক হিসেবে ওসি খায়ের তার শ্বশুর মো. এনায়েত করিমের নাম লিখে দেন। এ সময় হালিম মোল্লা তার বাড়িতে পরিবারসহ প্রবেশ করতে চাইলে মামলা ও গুমের হুমকি দেন ওসি।
হালিম মোল্লা বলেন, আমাদের কাছ থেকে জোর করে নেওয়া সাত শতাংশ জমির পাশাপাশি ক্রয় করেছেন মোট ৬০ শতাংশ জমি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি সরকারের খাস জমিও। সব জমি একসঙ্গে করেই গড়েন সীমানা প্রাচীর।
এদিকে সাইনবোর্ডে জমির তপশিল উল্লেখ থাকলেও পরিমাণ উল্লেখ নেই। সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, রেজিস্ট্রি বায়না সূত্রে এই জমির মালিক মো. এনায়েত করিম। জেএল নং৫৭, কুয়াকাটা মৌজা, বি এস খতিয়ান নং১২৮৪, বি এস দাগ ১২২৯। তবে বায়না রেজিস্ট্রি দলিল অনুযায়ী জমির পরিমাণ ৬০ শতাংশ। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।স্থানীয় বাসিন্দারা শুকুর মাঝি জানান, ওসি খায়ের তার শ্বশুরকে উপহার দেওয়া সম্পত্তিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সময় কোনো অর্থ পরিশোধ না করে হালিম মোল্লা নামের এক জমির মালিককে কারাগারে প্রেরণ করে জমি দখলে নিয়েছেন। অসহায় পরিবারটি আজ ভূমিহীন। সাবেক ওসির দুর্নীতির তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি এলাকাবাসীর।
কুয়াকাটা ফিশ ফ্রাই মার্কেটের সভাপতি মো. কাওসার ওসি খায়ের একজন অসৎ মানুষ। থানায় কর্মরত থাকাকালীন সময়ে আমাকে অফিসে ডেকে টাকা চান। আমি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি আমার দোকানের বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দেন। পরে টাকা দিয়ে সংযোগ আবারও চালু করি। এ ছাড়া আমার ফিশ ফ্রাইয়ের দোকান থেকে বিভিন্ন সময় মেহমান এবং তার পরিবার নিয়ে এসে মাছ খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে গেছেন।
স্থানীয় সাংবাদিক রুমি শরীফআমি বিএনপির সমর্থন করি বলে ওসি আমার দোকান থেকে প্রায়ই চাঁদা নিত। টাকা না দিলে মামলার হুমকি দিত। বিএনপি করি কেন সেজন্য সবসময় গালমন্দ করত। মহিপুর থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তার মতো অসৎ এবং দুর্নীতিবাজ ওসি এ থানায় আসেনি। ওসি খায়ের মহিপুর থানায় কর্মরত সময়কালে যেসব অপকর্ম করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
কুয়াকাটা পৌর ছাত্রদল নেতা সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালীন প্রতিমন্ত্রীর (সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান) ছেলে পরিচয় দিয়ে এই ওসি খায়ের বহু মানুষকে অত্যাচার করেছে। বিনা অপরাধে আমাকে বহু মামলায় অজ্ঞাত আসামি করার ভয় দেখিয়ে প্রায় প্রায় সময় মোটা অঙ্কের টাকা নিত। টাকা না দিলে থানার লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাত। টাকা দেওয়ামাত্র চলে যেত। ওসি খায়ের এভাবে শুধু আমাকে নয় বিএনপির সকল নেতাকর্মীকে রাত-দিন ভয়ভীতি ও হুমকির মাধ্যমে অত্যাচার চালাত। উনি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কলঙ্ক।
ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী ওসি খায়ের থানায় কর্মরত অবস্থায় প্রকাশ্যে চাঁদা গ্রহণ করতেন। আর ঘুষের অর্থ না দিতে পারলে বা অপারগতা প্রকাশ করলে গুম ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখাতেন। এ ছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমানের ক্ষমতা দেখিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাত। বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকানপাট থেকে বাকিতে মালামাল কিনে টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে একাধিক।
কুয়াকাটার বৈশাখী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক ইমাম হোসেন বলেন, মহিপুর থানার সাবেক ওসি খায়ের সাহেব এখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় কুয়াকাটা এলেই তিনি আমার হোটেলে খাওয়াদাওয়া করতেন। কিন্তু কোনো সময় টাকা পরিশোধ করতেন না। টাকা চাইলে বলতেন খাতায় লিখে রাখুন। এভাবে তিনি ২৭২৪০ টাকা বিল করেছেন কিন্তু বিল পরিশোধ না করেই চলে গেছেন। আমি আমার এই টাকা ফেরত চাই।
জনপ্রিয় অভিনেতা সাদ্দাম মাল তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিনা অপরাধে বাদীপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করে আমাকে বেশ কয়েক দিন জেল খাটিয়েছেন ওসি খায়ের। পরে আমার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে বলে ওসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন সে সময়। এ ছাড়া জমিজমা সংক্রান্ত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ওসি খায়ের আমার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়েছেন। বিষয়টি আমি তাৎক্ষণিক তৎকালীন উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছিলাম।
সাদ্দাম মাল আরও বলেন, তার কাছে (ওসি খায়ের) কেউ নিরাপদ নয়। দুর্নীতিবাজ সাবেক এই ওসির দুর্নীতির সঠিক তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।ওসি খন্দকার মো. আবুল খায়ের মহিপুর থানায় ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ১ জুন পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর সেখান থেকে পটুয়াখালী পুলিশ লাইনসে যান। সেখান থেকে বিশেষ তদবিরের মাধ্যমে কিছু দিনের জন্য ঝালকাঠি জেলার সদর থানার শেখেরহাট তদন্তকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে আবার তাকে ঝালকাঠি পুলিশ লাইনসে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে ঝালকাঠি সদর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত আছেন এই কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে পটুয়াখালীর মহিপুর থানা পুলিশের সাবেক ওসি খন্দকার মো. আবুল খায়েরের মুঠোফোনে একাধিকবার কল এবং হোয়াটসঅ্যাপে একাধিক এসএমএস দিলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নিউজ প্রচার না করার শর্তে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে।
এ বিষয়ে পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আহমাদ মাঈনুল হাসান বলেন, সাবেক ওসি খন্দকার মো. আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে জেলা পুলিশের কাছে কোনো ধরনের লিখিত অভিযোগ নেই। কেউ অভিযোগ দিলে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।