তিনটি গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্রিয় সংস্কার হওয়া পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকারকে সময় দিতে হবে

হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ আমীর, বাংলাদেশ শরীয়াহ আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়টা ছিল ২০২৪ সালে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। প্রথমে ধীর গতিতে চললেও ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউনের মাধ্যমে সারাদেশে আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পরে। ১৯ জুলাই থেকে সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। স্বৈরশাসক বার বার প্রচার করতেছিলো এই আন্দোলন ছাত্রদের কাছে নেই এটা বিএনপি ও জামাতের আন্দোলন এবং এই মিধ্যা কথাটা জনগণকে বিশ^াস করানোর জন্য নির্বাহী আদেশে জামাতের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়। বরবর্তীতে বিভিন্ন মিডিয়ার ভিডিওর মাধ্যমে দেখতে পাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারিদের ৮০% ছাত্র, ২০% অভিভাবক ও সাধারণ জণগণ। যাদের চেহারার মধ্যে বিপ্লবী ছাপ ছিল এবং স্বৈরশাসকের বিরোধ্যে প্রতিবাদের অগ্নিশিখা প্রকাশ পাচ্ছিল। ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার, খুনি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান। এই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। এই গণঅভ্যুত্থানকে সাধারণ জনগণ ২য় স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী স্বৈরশাসনের বিরোধ্যে বিএনপি, জামাত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অনেক রাজনৈতিক দলসমূহ হরতাল, মিছিল, মিটিং, সমাবেশ, অবরোধের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন কিন্তু কোন আন্দোলনই সফল হয় নাই বরং নেমে এসেছে নির্যাতন, খুন, ঘুম গায়েবী হাজার হাজার মামলার খড়গ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাত্র একমাস সময়ের অন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। বিদ্যুৎ এর লাইট জললে যেমন সবাই আলো পায়। সূর্যের আলো যেমন শুধু মুসলমানরা পায়না, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই সূর্যের আলো দিয়ে উপকৃত হয়। তেমনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অত্মত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। সকল মতের মানুষ ও সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা এবং দেশের ১৮ কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছে। ফিরে পেয়েছে বাকস্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার। আমরা দেখতে পেয়েছি হাজার হাজার মানুষ রাজনৈতিক মামলা থেকে জামিন পেয়েছেন। মুক্তি পেয়েছেন আয়না ঘর থেকেও। মুক্তি পেয়েছেন সাবেক প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। গণঅভ্যুত্থানের পর একটি বিপ্লবী সরকার গঠন হওয়ার প্রয়োজন ছিল কিন্তু এখানেও ছাত্ররা উদার নীতি অবলম্বন করে দেশের সুশীল ও বুদ্ধিজীবিদের দিয়ে কেয়ারটেকার সরকার গঠন করেন। যার নেতৃত্বে দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুছ। ড. মুহাম্মদ ইউনুছ তার এক ভাষনে বলেন বিপ্লবী ছাত্ররা আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। ছাত্রদের এই বুদ্ধিদীপ্ততা দেখে মনে পড়ল মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. বলেছেন রাজনীতিতে নেতারা বিক্রি হয় কিন্তু ছাত্ররা কখনো বিক্রি হয় না। বর্তমান রাজনৈতিক দল বা নেতৃবৃন্দর মূল আলোচনার বিষয় হলো! কেয়ারটেকার সরকার কতদিন থাকবে? যারা ক্ষমতার কাছা-কাছি মনে করেন তারা চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন কারণ নির্বাচন হলেই ক্ষমতায় বসতে পারবে। যারা এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব না তারা চাচ্ছে রাষ্ট্রিয় সংস্কার করা প্রয়োজন। যারা কখনো ক্ষমতার সাদ গ্রহণ করতে পারবে না, যেমন সাধারণ জনগণ তারা মনে করেন আওয়ামী স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি এখন আবার আরেক স্বৈরশাসকের হাতে ক্ষমতা যেন না যায়। সত্যিকারে কেয়ারটেকার সরকার কতদিন প্রয়োজন! আমি মনেকরি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে সকল দাবিসমূহ ছিল সকল দাবিগুলো বাস্তবায় করা। যে সমস্ত বিচার গুলো নির্বাচিত সরকারের আমলে হলে ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। এরকম তিনটি বিচার করে যেতে হবে কেয়ারটেকার সরকারকে। এক, ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পর থেকে ঢাকার তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানার ট্রাজেডি ঘটেছিল। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিককে হত্যা করে। পিলখানার গণহত্যার বিচার, কেয়ারটেকার সরকারকে করে যেতে হবে। দুই, ২০১৩ সালের ৫মে দিবাগত রাতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা-কর্মীদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে আওয়ামী স্বৈরশাসক। এই গণহত্যার বিচার, কেয়ারটেকার সরকারকে করে যেতে হবে। তিন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক আবু সাঈদ শহীদ হন এর পর থেকে ৩৬ জুলাই (৫আগস্ট) পর্যন্ত আওয়ামী স্বৈরশাসক যে গণহত্যা চালিয়েছে তার বিচার এই কেয়ারটেকার সরকারকে করে যেতে হবে। এই বিচার করতে ব্যর্থ হলে এই কেয়ারটেকার সরকার ব্যর্থ হবে। রাষ্ট্রিয় সংস্কার : ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার, খুনি শেখ হাসিনা প্রশাসনে যে দলিয়করণ, আত্মীয়করণ করেছে সকল সেক্টরে। প্রশাসনের সকল সেক্টরকে স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা মুক্ত করতে হবে। ভবিষ্যতে কোন নির্বাচিত সরকার পূণরায় স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে না পরে। সেসকল বিষয়গুলোর একটি সুন্দর সমাধান করতে হবে। তিনটি গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্রিয় সংস্কার হওয়া পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকারকে সময় দিতে হবে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে আওয়ামীলীগ সরকার শপদ নেন। যার মেয়াদ ছিল ২০২৮ সাল পর্যন্ত । ৬ মাস ২৬ দিন পর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। দ্বাদশ সংসদের বাকি সময়টা কেয়ারটেকার সরকার দেশ পরিচালনায় থাকতে পারে।