• সরকারের পালাবদলে ক্ষমতার প্রভাব ইসি কর্মকর্তা মনিরের
• জোর করে সংগঠনের আহ্বায়ক মনির, সদস্য সচিব মতিয়ুর
• বর্তমান কমিটির অনুপস্থিতিতেই নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন
ক্ষমতার পালাবদলের হাওয়ায় বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তাদের মধ্যে। সংগঠনের নামে সিনিয়র অফিসারদের মতামত উপেক্ষা করছেন জুনিয়ররা। ফলে বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনে বিভাজনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
শনিবার (৩১ আগস্ট) আগারগাঁওয়ের নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের আগামী নির্বাচন উপলক্ষ্যে সভায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করার কথা ছিল বর্তমান কমিটির। কিন্তু সভা চলাকালে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে সিনিয়র অফিসাররাসহ বর্তমান কমিটির সভাপতি ও মহাসচিব মাঝপথে বৈঠক থেকে বের হয়ে যান। পরে বর্তমান কমিটির সভাপতি ও মহাসচিব এবং সিনিয়র কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতেই নতুন কমিটির আহ্বায়ক নিজের পছন্দের অফিসারদের নিয়ে ২৫ সদস্যের বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন।
গত শনিবার রাতে নতুন আহ্বায়ক কমিটির পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ইসির উপসচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২) মোহাম্মদ মনির হোসেনকে আহ্বায়ক এবং টাঙ্গাইল জেলার সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমানকে সদস্য সচিব করা হয়।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) ইসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেন নির্বাচন পরিচালনা-২ শাখার উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পরপরই মনির হোসেন সর্বপ্রথম তার ক্ষমতার প্রয়োগ করে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার থেকে বদলি হয়ে সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেন।কর্মকর্তারা আরও জানান, সচিবালয়ে বদলি হয়েই মোহাম্মদ মনির হোসেন জোর করে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির ফাইল তোলেন। কিন্তু ইসি সচিবের কাছে গিয়ে তা আটকে যায়। কারণ, ইসি কর্মকর্তাদের উপসচিব হওয়ার পর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হতে হয়। তারপরই কেবল যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন। কিন্তু তিনি উপসচিব থেকে সরাসরি যুগ্মসচিব হতে চেয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি না চাওয়ায় সচিব তার ফাইল ফেরত পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া তিনি সিনিয়রদের টপকে যুগ্মসচিব হতে চেয়েছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শনিবার তিনি নিজেই ঘনিষ্ঠ অফিসারদের সমর্থনে আহ্বায়ক হন। পদটা তিনি নিজেই ডিমান্ড করেছিলেন। বর্তমান কমিটির সভাপতি ও মহাসচিবসহ সিনিয়র স্যাররা কেউ না থাকলেও মনির হোসেন নিজেই কমিটি করে নেন। শনিবার বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আনুষ্ঠানিক সভা চলার একপর্যায়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। বিশৃঙ্খলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিনিয়ররাসহ বর্তমান কমিটির সভাপতি ও মহাসচিব এবং কার্যনির্বাহী কমিটির অনেক সদস্য বের হয়ে যান। বর্তমান কমিটির ঊর্ধ্বতনরা চলে যাওয়ার পর অন্য কারও এ কমিটি করার এখতিয়ার নেই। এ ছাড়া শনিবারের মিটিংয়ের কোনো রেজুলেশনও হয়নি। সুতরাং বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন আহ্বায়ক কমিটি বৈধতা পাবে না।
নতুন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শনিবার আগের কমিটির মতামতের ভিত্তিতে এজিএমের সিদ্ধান্তের আলোকে নতুন কমিটি হয়েছে। বর্তমান কমিটির অনুমোদন নিয়েই এ কমিটি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
সিনিয়রদের অনুপস্থিতিতে এবং বর্তমান কমিটির অনুমোদন না নিয়েই এ কমিটি গায়ের জোরে করা হয়েছে– এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমান। তবে, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নাম বর্তমান কমিটিই ঘোষণা করেছে বলে দাবি করেন তিনি। তার এমন দাবি বর্তমান কমিটির সভাপতি স্বীকার করেননি।
শনিবারের মিটিংয়ের কোনো রেজুলেশন হয়েছে কি না– এমন প্রশ্নে মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমান বলেন, রেজুলেশনটা স্বাক্ষর হওয়ার অপেক্ষায় আছে, রেডি হচ্ছে আর কি। সবকিছু আইন অনুযায়ী হয়েছে। রেজুলেশন বর্তমান কমিটির সভাপতি ও মহাসচিব স্বাক্ষর করবেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানকে কল করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আলাউদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শনিবার আমাদের কমিটির মিটিং হয়েছে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মিটিংয়ের একপর্যায়ে আমরা বের হয়ে যাই। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে সম্মানের ঘাটতি ছিল। মিটিংয়ের কোনো রেজুলেশনও হয়নি। সেখানকার পরিবেশ খারাপ হয়ে যাওয়ায় এবং কোনো সিনিয়র না থাকায় সভার রেজুলেশন হয়নি। কিন্তু আমরা চলে আসার পর কী হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা অবগত নই। নতুন যে কমিটি হয়েছে সেটি আমরা ঘোষণা করিনি। সভার রেজুলেশন ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তের ভ্যালু নেই।
তিনি বলেন, শনিবারের আহ্বায়ক কমিটির বিষয়টি আমার নলেজে নেই। আমাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন কোনো কমিটি গঠন করার এখতিয়ার শুধু বর্তমান এক্সিকিউটিভ কমিটির রয়েছে। কেউ রেজুলেশন করে নিয়ে এলেও আমরা এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যদের মতামতের বাইরে যেতে পারব না। রেজুলেশনে স্বাক্ষর করতে হলে সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শনিবারের সভায় আহ্বায়ক কমিটির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
নতুন কমিটিতে মোহাম্মদ মনির হোসেনকে আহ্বায়ক এবং মোহাম্মদ মতিয়ুর রহমানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এ ছাড়া উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, কুমিল্লা জেলার সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার মো. মুনীর হোসাইন খান ও সিনিয়র সহকারী সচিব সাব্বির আহমদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে।
এ ছাড়া উপসচিব (চলতি দায়িত্ব) সহিদ আব্দুস ছালাম, চাঁদপুর জেলার নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ তোফায়েল হোসেন, বগুড়ার শেরপুর উপজেলার নির্বাচন অফিসার এ এস এম জাকির হোসেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের উপপরিচালক মো. রশিদ মিয়া, মৌলভীবাজার জেলার নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ শাহীন আকন্দ, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের সহকারী পরিচালক এ এস এম ইকবাল হাসান, বরগুনার বামনা উপজেলার নির্বাচন অফিসার মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ সেখ, মতিঝিল থানার নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ আশফাকুর রহমান, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নির্বাচন অফিসার আল আমিন, দিনাজপুর সদর উপজেলার নির্বাচন অফিসার মো. আনোয়ার হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নির্বাচন অফিসার খ ম আরিফুল ইসলাম, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার নির্বাচন অফিসার শেখ মোহাম্মদ আদিল, সহকারী সচিব মো. মমতাজ-আল-শিবলী, নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার নির্বাচন অফিসার রিয়াজ আহমেদ, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার নির্বাচন অফিসার মো. ফারুক হোছাইন, সহকারী সচিব আরাফাত আল হোসাইনী, সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার নির্বাচন অফিসার মো. আল নোমান, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নির্বাচন অফিসার হাসান আল মাহমুদ ও ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার নির্বাচন অফিসার রনি আহমেদকে সদস্য করা হয়েছে।