*ছেঁড়াস্মৃতি* আব্দুর রউফ মান্নান

অনলাইন সংস্করণ                                                                                                                                – ০৯ ( ৪৯ থেকে ৫২ পৃষ্ঠা)

*নায়িকা সুচন্দার সঙ্গে পরিচয়*

ষাটের দশকে বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী নায়িকা সুচন্দার পরামর্শে আমি আর্ট কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। চিত্রকলা বা অঙ্কনবিদ্যার প্রতি আমার সহজাত আকর্ষণ সেই ছোটবেলা থেকেই। তবে বিমূর্ত চিত্রকলা বা শিল্পী মনের কল্পিত ছবি আঁকার প্রতি তেমন ঝোঁক ছিল না। আর বিমূর্ত চিত্রকলা কি তাও বুঝতাম না ।

মেসে থাকতে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি ছবি আঁকতাম। রং, তুলি আর আর্ট পেপারে ভরা থাকতো আমার টেবিল। প্রতিদিন একটা করে ছবি আঁকতাম। একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি আঁকলাম। এটা আঁকতে তিন/চার দিন সময় লেগেছিল। ছবিটা মেসের সব মেম্বার দেখেছিল। সবার একই প্রশ্ন কোনো আর্ট কলেজে শিক্ষা না নিয়ে কী করে এমন ছবি আঁকতে পারলো ! আমার পড়ার টেবিলের উপর ছবিটি ছিল। দু’তিন দিন পর দেখি ছবি নেই। কে নিয়ে গেল হদিস পেলাম না। পাশের বাসার অর্থাৎ ১৭ নম্বর নন্দলাল দত্ত লেনের এক ছেলে মাঝে মাঝে আমার রুমে আসতো, বেশ ভদ্র ছেলে, গল্পসল্প করে চলে যেত। আমার সন্দেহ হলো সেই কি ছবিটা নিয়ে গেল? সেটি আর পাইনি।

সে সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিক চিত্রালী পত্রিকার একটি সংখ্যায় হিট নায়িকা সুচন্দার সাদাকালো একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। ওই ছবিটা দেখে স্কেলের মাধ্যমে আমি অবিকল সুচন্দার একটা ছবি আঁকি। মেসের সবাই দেখে অবাক, প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমারো মনে হলো এটাই আমার আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবি। আমার মেসের বন্ধু নওরেশ ছবিটা দেখে বলল- ‘সুচন্দা আমার নিকট আত্মীয়, গেণ্ডারিয়া থাকে। তুমি যদি তাকে এই ছবিটা উপহার দাও তা হলে সে খুব খুশি হবে এবং নিশ্চিত এটা তাঁর বাসার দেয়ালে টানিয়ে রাখবে।’

এ কথা শুনে আমি খুব আনন্দিত হলাম। পরের দিন ক্লাস বাদ দিয়ে সকাল ১০ টার দিকে নওরেশের সঙ্গে সুচন্দার গেণ্ডারিয়ার বাসায় গেলাম। আমাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে রেখে বন্ধুটি অন্দরমহলে চলে গেল। বেশ কিছু পরে কাজের মেয়ে চা-মিষ্টি দিয়ে গেল। বাড়িতে লোক সমাগম শুরু হলো এবং ধীরে ধীরে রুমের সোফা, চেয়ার সব ভরে গেল। অনেক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি ছাত্র মানুষ বসে আছি, খারাপ লাগলো, উঠে দাঁড়ালাম। এদিকে আমার বন্ধু, সেই যে অন্দরমহলে গেল আর ফেরার নাম নেই। কিছুক্ষণ পর সুচন্দা বৈঠকখানায় এলেন, তাঁর পেছন পেছন আমার বন্ধুটিও আসলো। চিত্রজগতের লোকজনের সঙ্গে কথা শেষ করে তাদের বিদায় দিয়ে সুচন্দা আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কিসের জন্য এসেছো? আমি অতি যত্নে রাখা সুচন্দার ছবিটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললাম- ‘এটা আমি এঁকেছি।’ আমি কোথায় থাকি, লেখাপড়া কী করি, দেশের বাড়ি কোথায় ইত্যাদি জানতে চাইলেন সুচন্দা। আমাকে বেশ আদরের সুরে বললেন, ‘ তুমি তো খুব সুন্দর ছবি আঁকো। আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যাও, ভাল করবে। তোমার আঁকা আমার ছবিটা রেখে দিলাম।’

সুচন্দা তখনকার বাংলা ছায়াছবির নামকরা নায়িকা, আমার মতো গ্রামের এক সাধারণ ছেলেকে বলছেন আর্ট কলেজে ভর্তি হতে। এ তো স্বপ্নের কথা, আনন্দের কথা। আমি তাঁর বাসায় থাকতেই সিদ্ধান্ত নিলাম, যে করেই হোক আর্ট কলেজে ভর্তি হবোই হবো।

মেসে ফিরে সুচন্দার ওই কথা- আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যাও, ভাল করবে, বারবার আওড়ালাম, ‘আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যাও, ভাল করবে।’ রাতেই আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি চেয়ে দাদার কাছে চিঠি লিখলাম । চিঠি পেয়ে দাদা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তরে লিখলেন- ‘তোমাকে এসডিও- ডিসি হতে হবে। আমি এটা দেখার জন্যে বেঁচে আছি। সুতরাং আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।’

দাদা বিষয়টি আমার মাকেও জানালেন। মা লেখা-পড়া জানতেন না, সে কথা আগেই বলেছি। তিনি গ্রামের কাউকে দিয়ে লিখিয়ে এক দীর্ঘ চিঠি পাঠালেন আমার কাছে। চিঠিতে মা লিখেছেন ‘বাবা তোমাকে আমি দেখে শুনে মানুষ করতে পারি নাই। তোমাকে না দেখে আমি পাগলের মতো থাকি। তুমি আর্ট কলেজে ভর্তির চিন্তা করছো, যা মোটেই ভালো নয়। তোমার দাদা যেভাবে লেখাপড়া করতে বলেছেন, তাই করো।’

চিঠি পড়ে আবার মার কথা মনে পড়ে গেল। অনেক লম্বা চিঠি, কত অনুরোধ আর আদর-সোহাগ করে চিঠি দিয়েছেন আমার মা। আমি চিঠিটা বারবার পড়লাম। যতই পড়ি ততই যেন মা আমার কাছে চলে আসছেন। মনে পড়ছে কতকাল হলো মাকে মা বলে ডাকতে পারিনি। কি ভুল যে মা করেছেন, তা মা বারবার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। আমি তাঁর একমাত্র ছেলে- কত মানত, কত দরগায় দরগায় বাবা-দাদা মিলে ধর্ণা দিয়েছেন। আল্লাহর কাছে ছেলে সন্তানের জন্য আকুল প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু মা-বাবার ভাগ্য হয়নি আমাকে লালন পালন করার। এই রকম চিঠি মা অনেকবার লিখেছেন। আমার মা খুব ধর্মপরায়ণ মহিলা ছিলেন। সেই ছোটবেলায় আমি দেখেছি, মা গভীর রাতে তাহাজ্জতের নামাজ পড়ে মৃদুস্বরে কোরআন শরীফ পাঠ করতেন। আমরা ভাই-বোন মায়ের কোরআন পাঠ শুনে শুনে বড় হয়েছি।

অনেক সময় ভাবতাম এত ঐশ্বর্য থাকতেও মা কেন আমাদের ফেলে অন্যের সংসার করতে গেলেন? মাঝে মাঝে এসব কথা ভেবে মাকে দোষারোপ করতাম। তবে তা ক্ষণস্থায়ী। আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কথাগুলো ভাবনায় আসতো বেশি বেশি। কিন্তু কূলকিনারা পেতাম না। কেনইবা দাদা মাকে জোর করে বিয়ে দিলেন। আমার নানা বাড়ির অবস্থা হয়তো ভালো ছিল না। কিন্তু দাদা বিশাল ধন-সম্পদের মালিক। প্রায় চার’শ বিঘা জমি। বছরে হাজার-দেড় হাজার মণ ধান, তিন চার’শ মণ গুড় পান। আমার মায়ের মতো একজন মানুষকে প্রতিপালন করা তো দাদার জন্য সমস্যার কারণ ছিল না। মাত্র ১০ বিঘা জমির লোভ দাদাকে গ্রাস করেছিল। যার কারণে সব বুঝেও আমার চাচার সাথে দাদা আপোস করে এবং মাকে অন্যের সাথে বিয়ে দিতে দাদা বাধ্য হয়েছিল। এসব ভেবে ভেবে অনেক সময় দাদার প্রতিও অভিমান হতো ।

শীত ও গ্রীষ্মকালীন কলেজ ছুটি হলেই ঢাকা থেকে ট্রেনে চাপি বাড়ির পথে। সে সময় ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি মেইল ট্রেন সান্তাহার যেত। ঢাকা থেকে সান্তাহার ইন্টারক্লাসের ভাড়া ছিল মাত্র ১০ টাকা। ট্রেনে প্রথম শ্রেণি বা ফার্স্ট ক্লাস এবং ইন্টারক্লাস বা মধ্যম শ্রেণি এই দুই নামে ট্রেনের কামরার শ্রেণিবিন্যাস ছিল। সান্তাহারে ট্রেন থেকে নেমে নওগাঁ যেতে সময় লাগতো মাত্র ১৫ মিনিট। তারপর বাসে নজিপুর তিন ঘন্টার পথ। নজিপুর থেকে ৬ মাইল পথ পায়ে হেঁটে আমাইপুকুর। আমি অবশ্য নওগাঁ গিয়ে একরাত ফিরোজা বুবুর বাসায় থেকে পরদিন বাড়ি যেতাম।

বাড়িতে আমাদের মোট আটটি শোবার ঘর। আমার ভাগে চার এবং চাচার ভাগে চার। দাদা আমার অংশের মধ্যে থাকতেন, দাদি চাচার অংশে। বড় মা, দাদা আমরা এক অংশে থাকি। শুধু রান্নাঘর ছিল একসঙ্গে। দাদা একদিন শরিকদের ডেকে সেটাও দুই ভাগ করে দিলেন। তখন থেকে আলাদা পাকে খাওয়া-দাওয়া শুরু হলো- চাচার সঙ্গে আপাতত মনোমালিন্যের অবসান হলো। এবার আমি বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। পরবর্তীতে চাচা আমার সাথে আর কোন খারাপ আচরণ করেন নাই। চাচা অসুস্থকালীন আমি তাকে কয়েকবার দেখতে গিয়েছি। চাচি আমাকে কোনদিন কটুকথা বলেন নাই। তাদের ছেলে-মেয়েদের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক আছে অদ্যাবধি।

ছুটি শেষে আমি ঢাকা ফিরে গেলাম। কয়েকদিন পরেই ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা। পড়ালেখা খুব একটা ভালো হয়নি। যেনতেনভাবে পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার পর আর বাড়ি আসলাম না। মেসের অধিকাংশ ছাত্রই সেবার বাড়ি যায়নি। প্রতিদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে, নয়তো সিনেমা হলে এই আমার রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়ালো । আমার মনে অনাবিল শান্তি । মনে হয় সুখ সাগরে ভাসছি। দাদা নিয়মিত মাসের খরচের টাকা পাঠাতেন। একেবারে হিসেব করে নয় বরং ঢাকা শহরে খরচ বেশি বলে মাসের খরচের চেয়ে বেশি টাকাই পাঠাতেন তিনি। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো। কোনো রকমে থার্ড ডিভিশনে পাশ করলাম। আবার জগন্নাথ কলেজেই বিএ ভর্তি হলাম। দাদা ও মাকে চিঠি লিখে সব জানালাম। চিঠির উত্তরে মা-দাদা উভয়েই আমাকে বাড়ি যেতে বললেন। প্রায় ছ’মাস হয়ে গেল বাড়িতে যাই না। রোজার ঈদে বাড়ি ছিলাম। কিন্তু কোরবানীর ছুটিতে বাড়িতে যাব না বলে দাদা ও মাকে চিঠি লিখে জানালাম। ঐ ঈদে আমি একটা বড় সাইজের মোরগ কিনে নিজে রান্না করে ঈদ পালন করেছি। তাছাড়া চারতলায় বসবাসকারী বাড়ির মালিক রহমান সাহেব আমাদের ঈদের পরের দিন দাওয়াত করে ছিলেন।

*পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের জনসভায়*

১৯৬৮ সাল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তাল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতনের দামামা বাজতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

আমার বন্ধু হানিফ-উজ-জামানের কাছে তার পরিবারের সমস্ত ইতিহাস আগেই জেনেছিলাম। প্রতিদিন তার কথা শুনতে শুনতে মেসের সব ছাত্র ও কর্মজীবীরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে শুরু করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেষে ১৯৬৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পল্টন ময়দানে বিশাল একটা জনসভা হয়েছিল। লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ। হানিফসহ আমরা মেসের সবাই সে জনসভায় উপস্থিত হই। সে দিনই আমি খুব নিকট থেকে বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনেছিলাম।

জনসভা শেষে আমরা মেসে ফিরি। আর শেখ মুজিবের সেই জ্বালাময়ী ভাষণ রাতভর আমার কানে বাজতে লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, এরকম যদি আমিও নেতা হতে পারতাম! আমার ডাকে যদি এত লোকের সমাগম হতো, তাহলে বাকি জীবনটা রাজনীতির ময়দানেই কাটিয়ে দিতাম। হাস্যকর ভাবনায় বটে। পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবের সেদিনের সে ভাষণ শুনেই রাজনীতিতে আমার আগ্রহ বদ্ধমূল হয়। কলেজে যারা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এমন কিছু ছেলেকে খুঁজে তাদের সহযোগিতায় আমি ছাত্রলীগের সদস্য হই। নিয়মিত মিটিং, মিছিল করতে থাকি। এরকম একটি মিটিংই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। খেলা বা সিনেমা দেখে সময় নষ্ট না করে বরং রাজনীতির মাঠে সরব আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেই খুব ভালো লাগতো ।

আমার হাতের লেখা ভালো ছিল বা আর্ট করতে জানতাম বলে কলেজ ছাত্রলীগের পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে। কলেজে ব্যাপক তারিফ শুরু হলো আমার। যেকোনো অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ বা মিছিলে আমার উপস্থিতি নিয়মিত হতে থাকলো।

চলমান …………………..

(গল্পটি ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করুন)