*ছেঁড়াস্মৃতি* আব্দুর রউফ মান্নান

অনলাইন সংস্করণ – ১০ ( ৫৩- থেকে ৫৬ পৃষ্ঠা)

*আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা: শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু উপাধি*

শেখ মুজিবুর রহমান এবং চৌত্রিশজন রাজনৈতিক নেতা, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ী এবং আমলাকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার কথিত ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়। মামলার পর একদিন শেখ মুজিবকে ঢাকা জজ কোর্টে আনা হয়। সেদিন আমি এবং বন্ধু হানিফসহ জগন্নাথ কলেজের বেশ কিছু ছাত্র ঢাকা জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম, বারান্দা ধরে শেখ মুজিব তাঁর চিরচেনা টোব্যাকো পাইপ টানতে টানতে এগিয়ে চলেছেন বীরদর্পে এজলাসের দিকে, আগে পিছে পুলিশ প্রহরা। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় ।

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি ঘোষণা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এ সময় কিছু স্লোগান প্রচলন করে। আমরা মিছিল মিটিংয়ে এসব স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলতাম। যেমন: ‘জাগো, জাগো, বাঙালি জাগো, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, জয়বাংলা’ ইত্যাদি। দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেয়। সভাপতি ছিলেন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। হর্ষোৎফুল্ল জনতা লাখো কণ্ঠে তা সমর্থন করে। শেখ মুজিব দেশবাসী এবং ‘বিপ্লবী জনতার’ প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে এই উপাধি বা সম্মাননা গ্রহণ করেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা তোফায়েল আহমেদ, আ.স.ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, কাজী ফিরোজ রশিদসহ অন্যান্য নেতারা জগন্নাথ কলেজে সিরিজ মিটিং করতে লাগলেন। সেখানে হানিফ আমার সঙ্গে থাকতো। পাশাপাশি আবার পড়ালেখার প্রতিও মনোনিবেশ করলাম। চিন্তা হলো, পড়ালেখা না করলে বিএ পাশ করতে পারবো না। তখনকার দিনে বিএ বা বিএসসি পাশ করা বেশ কঠিন ছিল। পাশের হার শতকরা ২৫/৩০-এর বেশি ছিল না। আমি অতিরিক্ত সাবজেক্ট হিসেবে ভূগোল নিয়েছিলাম। নিয়মিত ক্লাসও করতে লাগলাম। তখন মনে হতো, এই তো এবার আমি প্রকৃত ছাত্র হয়েছি। একটা দিনও কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিতাম না ।

বিএ প্রথম পর্বের পরীক্ষা শেষে প্রায় ৭ মাস পর বাড়ি গেলাম । আহাম্মদ, কাফিজসহ গ্রামের সহপাঠিদের সঙ্গে দেখা হতে সবাই আমাকে আমার স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বাহাবা দিতে শুরু করলো। মা, দাদা, দাদি সবাই তখন বাড়িতেই ছিলেন। আমাদের গ্রামের যারা কলেজে পড়ালেখা করছে তাদের সবাই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতনের শেষ ঘন্টা তখন বেজে উঠেছে। বাংলার মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল। আমরা আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের এলাকায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আলোচনা বৈঠক করি। এতে সর্বস্তরের জনগণের অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। অথচ কিছুদিন আগেও এসব অঞ্চলে মুসলিম লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলের খবরই ছিল না।

আমাদের ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন অফির উদ্দীন চৌধুরী নামে মুসলিম লীগের স্থানীয় এক নেতা। আমার দাদাও তৎকালীন ইউনিয়ন কাউন্সিলের মনোনীত মেম্বার ছিলেন। স্বভাবতই দাদাও মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। এরমধ্যে আমরা এলাকায় মুসলিম লীগ বিরোধী আওয়ামী লীগ তথা ছাত্রলীগের রাজনীতির বীজ বপন করতে সক্ষম হই। তখনকার যুগে আমাদের এলাকায় আমরা কয়েকজন ছাড়া বিএ অথবা বিএসসি পাস বা অনার্স ক্লাসের ছাত্র ছিল না। কাজেই আমদের কথা সবাই বিশ্বাস করতো। আহাম্মদ অনার্সে রাজশাহী কলেজে, কাফিজ মহাদেবপুর কলেজে আমি এবং মজিবর জগন্নাথ কলেজে বিএ পড়তাম। আমরা ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এলেই নিয়মিত ফুটবল খেলতাম, আড্ডা দিতাম, ব্রীজ খেলতাম ।

*১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরী*

১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নগ্নপদে প্রভাতফেরী করে শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা থেকে শোভাযাত্রা সহকারে শহীদ মিনারে যেতে হবে। আন্দোলন সংগ্রাম সম্পর্কে

কোনো কিছু জানতে পারলেই আমরা (ছাত্ররা) সেখানে ছুটে যেতাম। ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের একটা মিটিং হয়। আমি হানিফ-উজ-জামানকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হই। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত তিনটার মধ্যে লক্ষ্মীবাজারের রুচিরা হোটেলে আসতে হবে। এখান থেকে দলবদ্ধ হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির সেই কালজয়ী সংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ সমবেতকণ্ঠে গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে যেতে হবে। আমি এর আগেও সেখানে গিয়েছি, তবে দলবদ্ধভাবে নয় ।

১৯৬৯ সালের আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তখন আইয়ুব খানের মুসলিম লীগের সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল এনএসএফ। এদের প্রধান কাজ ছিল পেশীশক্তি ব্যবহার করে সরকার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিহত করা। সরকার এই পেটোয়া সংগঠনকে অর্থ এবং অস্ত্র যোগান দিয়ে লালন-পালন করতো। এনএসএফ-এর পাণ্ডাদের মোকাবিলা করতে ছাত্রলীগকে সাংগঠনিকভাবে সুসংহত করা হয়। এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার যে, ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সরকার বিরোধী সংগঠনের ছাত্ররা আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। তখন মূলত ছাত্ররাই আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখসারির যোদ্ধার ভূমিকা পালন করতো। তারা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতেও সক্ষম হয়।

জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা, বিশেষ করে ছাত্রলীগ সদস্যরা লক্ষ্মীবাজারে রুচিরা হোটেলে ২১ ফেব্রুয়ারি রাত তিনটায় সমবেত হয়। বাদ্য-বাজনাসহ অঞ্চলভিত্তিক গায়ক-গায়িকারাও অংশ নেয়। নারিন্দা, লক্ষ্মীবাজার ও বাংলাবাজার এলাকা থেকে শত শত ছাত্র-ছাত্রী এবং সাধারণ জনতা এই প্রভাতফেরীতে যোগ দেন। দুই সারিতে প্রভাতফেরীর মিছিল সাজানো হয়। এক সারিতে ছেলেরা এবং অন্য সারিতে মেয়েরা। মাঝখানে গায়ক-গায়িকারা। মিছিলের পুরোভাগে ব্যানার নিয়ে দু’জন। সবার মুখে মুখে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি ” গান। আমি ও হানিফ-উজ-জামান ব্যানার ধরেছিলাম। প্রভাতফেরীর সেই সুশৃঙ্খল মিছিলটি ভোর চারটার দিকে শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেদিনের সেই প্রভাতফেরীর মিছিলটি আমার সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। এখনো ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১শে ফেব্রুয়ারি’ এই মর্মস্পর্শী সংগীতটি আমার মধ্যে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত, দু’টি ভূখণ্ডের দু’টি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। এই ইতিহাস বাংলাদেশের অনেকেরই জানা। কিন্তু এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরও অনেক সংগ্রামের ইতিহাস ।

৬৯-এর গণআন্দোলন

১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে যা পরে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। গোটা দেশ বিক্ষোভ, সমাবেশ-মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পতনের মুখে ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানান। জেনারেল ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। এর আগে একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব খান।

নব্য সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৬৯-এর নভেম্বরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ।

জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ১০ দিন পর অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮টি আসন।

চলমান …………………..

(গল্পটি ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করুন)

লেখক: কবি, সাহিত্যিক ও নাগরিক ঐক্যের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রউফ মান্নান