বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজন নতুন রাজনীতি ও নতুন নেতৃত্ব-এম এ আলীম সরকার

বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টির আহ্বায়ক এম এ আলীম সরকার ৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সনে ১২ই জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান এই নতুন রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই নতুন রাষ্ট্র ও জনজীবন পরিচালনা করতে থাকে। তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তানকালের জাতীয় সংসদের ও প্রাদেশিক পরিসরে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের এবং সংবিধানকে কার্যকর করার ঘোষণা দেন এবং কাজ করতে থাকেন। কিন্তু ওই সরকারের কার্যক্রম দ্বারা বাংলাদেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। শেখ সাহেব নিজে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার শাসন ক্ষমতা সুসংবদ্ধ হয়নি। এক পর্যায়ে তিনি অনুভব করেন যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে সমস্যাবলি সমাধান করা যাবে। এরকম ধারণা নিয়ে তিনি জাতীয় সংসদে বাকশাল নামে এক সরকার গঠন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মত ব্যবস্থা প্রবর্তনের অগ্রসর হন। তিনি আশা করেছিলেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থায় তাঁর এবং আওয়ামী লীগের তাঁর রচিত সরকার ব্যবস্থা তাঁর ও আওয়ামী লীগের আরও বেশি পরিপন্থী হয়ে যায় এবং ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট তাঁকে এবং তাঁর বাড়িতে অবস্থানকারী সকলকে হত্যা করা হয়। ওই দিন একই দিনে তাঁর ভগ্নিপতি এবং তাঁর অন্য এক বোনের সন্তান শেখ ফজলুল হক মনিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যেসব কারণ সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো তাঁর নেতৃত্ব ও শাসনব্যবস্থার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। তারপর খন্দকার মুস্তাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা হারান। তখন সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় নতুন সরকার গঠন করা হয়। তখন খন্দকার মুস্তাক আহমেদ মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রদূত করেন। এতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হন। জাস্টিস সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছাড়াও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও ছিলেন। তখন বাস্তবে সে অবস্থায় জাস্টিস সায়েম এর পাশে প্রধান সেনাপতি ও উপরাষ্ট্রপতি-উপসামরিক প্রশাসক জিয়াউর রহমান হয়েছিলেন। কার্যত জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। তার মধ্যেই বিচারপতি সায়েম জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। অবস্থার চাপেই জাস্টিস সায়েম এরকমটি করেছিলেন। পরে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদ ক্ষমতাসীন হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধতর ওই বছরগুলিতে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিপন্ন এবং আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থাও ছিল অত্যন্ত করুন। তবে সরকারের প্রতি অনাস্থা  নিয়েও শ্রমিক-কৃষক ও মধ্যবিত্ত জনগণ জাতি ও রাষ্ট্রকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য শ্রমশক্তি ব্যয় করেছে। এরপর ১৯৯১ সালের প্রায়  শুরু থেকেই বাংলাদেশে জনজীবন ছিল নিরাপত্তার অভাবে এবং দুর্ভিক্ষের মধ্যে।  শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে ১৯৭৪ সালে ঘটেছিল এক মনন্তর।  ১৯৯০ সনে গণ-আন্দোলনের মধ্যে এইচএম এরশাদের পদচ্যুতি ঘটে এবং তারপর নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তনের ধারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দেখা দেয়। কিন্তু জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিবার সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের যোগ্যতা অর্জন না করার প্রমাণ দিয়েছেন। এখনও জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে নিয়ে ডঃ ইউনুসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আর রাজনৈতিক নেতাদের ও রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ত্তে নেই। রাষ্ট্র হিসেবেও বাংলাদেশ চলছে এক ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার মধ্যে দিয়ে। ডঃ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ সুষ্ঠু  নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে  চলছে। বিএনপি ও আরো কোনো কোনো দল অতিদ্রুত জাতীয় সংসদের নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার দাবি তুলছে। উপদেষ্টা পরিষদ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারে  প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিভিন্ন অঙ্গে সংকট ও সমাধানের উপায় নির্ধারণের চেষ্টা করছে। ক্ষমতাসীন উপদেষ্টা পরিষদের প্রতিশ্রুতির ওপর এখনও আশা রাখছে। জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন কবে হবে এবং নির্বাচনের আগেকার কর্মসূচি কি হবে তা উপদেষ্টামন্ডলী থেকে কোনো সুস্পষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হচ্ছে না। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার একান্ত  দরকার। কিন্তু তা মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি সংকটের অবসান ও সুষ্ঠু  ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণাকে সুস্পষ্ট করা এবং গণজাগরণ ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। উপদেষ্টা পরিষদের কার্যক্রমের ওপর অতিরিক্ত ভরসা করে রাজনীতিক নেতৃত্বের তৎপরতা দরকার। তার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন একান্তই অপরিহার্য। রাজনৈতিক দল গঠনের দ্বারা উন্নতিশীল নতুন রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। সুষ্ঠু রাজনীতির দিকে এগোতে হলে প্রকৃষ্ট  রাজনৈতিক দলের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির উন্নতির জন্য নতুন রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি একান্তই করণীয়। বাংলাদেশের অপেক্ষাকৃত তরুণ রাজনীতিবিদদের থেকে এই নতুন রাজনীতি নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা একান্ত দরকার। বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টি সেই লক্ষ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশে এখন সময়ের দাবি বর্তমান রাজনীতি চিন্তা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন চিন্তা ও কর্ম। রাজনীতিতে যে নতুন রাজনীতি ও সরকার অভিপ্রেত কর্মীদের থেকে এটাই দেশবাসী আশা করে। এই লক্ষ্যে যে কার্যক্রম দরকার তারজন্য প্রস্ততি গ্রহণ করতে হবে এবং অন্তত  পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। যুগে যুগে দেশে দেশে আমূল পরিবর্তনের আন্দোলনে ও সংগ্রামে তরুণরাই অগ্রদূতের  ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের তরুণদের এব্যাপারে সক্রিয় আশাবাদের পরিচয় দিতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের একুশদফা আন্দোলন, আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তরুণরাই অগ্রযাত্রী ছিলেন এবং ক্রমে তারা প্রবীণ হয়েছেন।

আজকের অবস্থায় করণীয় কী?
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন এবং তার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কার্যক্রম চলার মধ্যে আওয়ামীলীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তিনি দিল্লিতে অবস্থান করছেন। তাঁর এই পালিয়ে যাওয়ার দ্বারা আওয়ামী লীগ দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আন্দোলনকারী মহল থেকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসকে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা করে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। এই উপদেষ্টা পরিষদই রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। এখন মন্ত্রীপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নেই। রাজনীতিক দলগুলো গণতন্ত্রকে নির্বাচনতন্ত্রে পরিণত করেছেন। কেবল নির্বাচনই যেন এদের রাজনীতি। প্রকৃতপক্ষে কোনো রাজনৈতিক দলে ও নেতাদের মধ্যে কোনো আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনা নেই। রাজনীতিকে তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ও নির্বাচিত সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ বিধিব্যবস্থা সংস্কার করার জন্য কাজ করছেন। তাঁদের গণমুখী কার্যক্রম সফল হোক এটাই আমরা চাই। তবে আমরা মনে করি সর্বজনীন গণতন্ত্রের লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অগ্রসর হওয়া একান্ত দরকার। রাষ্ট্র ব্যবস্থার সার্বিক পর্যায়ক্রমিক ও নির্বাচিত সরকারকে করতে দেওয়া উচিত। আদতে দলগুলো এবং নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে জনগণের সমস্যাবলির সমাধানের ও সার্বিক উন্নতি সাধনের জন্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। রাজনীতিবিদদের থেকে রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও জনজীবনের সমস্যাবলি সমাধানের লক্ষ্যে অনেক কাজ করা দরকার। উদ্দেশ্যনিষ্ঠ নেতৃত্বও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠে নাই। দেশবাসী চায়, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি প্রস্তুতি দেখতে চায়। দেশবাসীর এই চাওয়াকে মূল্য দেওয়া দরকার। আমরা কেবল সরকার উৎক্ষাতের ও ক্ষমতা  দখলের রাজনীতি পরিহার করে রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন ও জনজীবনের কল্যাণে সার্বিক প্রস্তুতির কার্যক্রম দরকার। উপদেষ্টামন্ডলীর  প্রতি সহযোগিতা করার পাশাপাশি দরকার রাজনীতিক দলগুলোর স্বতন্ত্র কার্যক্রম। রাজনীতিক দলভিত্তিক প্রতিনিধির আনুপাতিক ভিত্তিতে সরকার গঠনের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি দরকার। বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টির তাত্ত্বিক ও সর্বজনীন গণতন্ত্রের প্রবর্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রণীত আটাশদফা সর্বজনীন গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা পুনর্গঠন হলে উন্নতিশীল সম্প্রীতিময় নতুন বাংলাদেশ এবং উন্নতিশীল সম্প্রীতিময় নতুন রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠিত হবে।